Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

দুঃখের ঝর্ণা

798 |
Share
| ১৫ এপ্রিল, ২০২১
ঝিলমিল বসু

বিজ্ঞাপনকর্মী ও রেডিও উপস্থাপক

চিত্র: নোহকালিকাই প্রপাত; সৌজন্য: wikipedia

একটা ক্যানভাস— তাতে ঘন সবুজ জঙ্গল, দুধসাদা জলধারা, নিচে এসে একটা কূপের মতো জায়গায় সেই জল পান্নার মতো সবুজ ও কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে জমে আছে। কখনও সাদা ধোঁয়ার মতো মেঘ ঘিরে আছে, আবার কখনও রোদের চাদর! ক্যানভাস তো বটেই, কিন্তু প্রকৃতির তৈরী ক্যানভাস, আর এই ছবির মতো সুন্দর জায়গাটি হল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির খুব কাছেই অবস্থিত নোহকালিকাই জলপ্রপাত। প্রায় ১১১৫ ফুট উচ্চতা থেকে ঝুপ করে মাটিকে প্রণাম করার জন্যই যেন নেমে এসেছে এই জলপ্রপাত আর তৈরি করেছে কূপের মতো এক জলাশয়। মনোরম দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত এই নোহকালিকাই জলপ্রপাতের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়াবহ লোকশ্রুতি।

‘নোহকালিকাই’ শব্দটি একটি খাসি শব্দ যার মানে ‘jump of Ka Likai’। খাসি ভাষায় মহিলাদের ‘কা’ বলা হয় আর এই প্রচলিত গল্পটি যাকে নিয়ে তার নাম লিকাই। অনেক বছর আগে লিকাই নামের এই ভদ্রমহিলা এই জলপ্রপাতের কাছেই রংজির্তে নামক এক গ্রামে থাকত তার স্বামীর সঙ্গে। লিকাইয়ের মেয়ের জন্মের পর পরই মারা যায় তার স্বামী। টাকাপয়সার অভাবে একা হাতে মেয়েকে মানুষ করা লিকাইয়ের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে সে এক জায়গায় কুলির চাকরি নেয়। বাইরে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে এসে ঘরে ছোট্ট মেয়েটাকে দেখভাল করতে করতে লিকাইয়ের মনে হয় যে একটা বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে বাবা-মা দুজনেরই প্রয়োজন। তাই সে অনেক ভেবেচিন্তে আরেকবার বিয়ে করে।

বিয়ের পর এক নতুন সমস্যা দেখা দেয়। লিকাইয়ের স্বামী লিকাইয়ের কাছ থেকে যতটা সময় ও গুরুত্ব পাবে ভেবেছিল ততটা পায় না কারণ কাজ থেকে ফিরে লিকাই তার ছোট্ট মেয়েটার পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো রোজ। এইভাবে ধীরে ধীরে ওই বাচ্চাটার প্রতি তার মনে ঘনীভূত হতে থাকে হিংসা ও রাগ। একদিন লিকাই কাজে বেরিয়ে যেতেই রাগে অন্ধ হয়ে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বামী প্রাণে মেরে ফেলে বাচ্চাটিকে।

লিকাই সময়মতো কাজ থেকে বাড়ি ফিরে খুঁজতে থাকে তার মেয়েকে। খুঁজে পায় না। ভাবে পাশের বাড়িতে খেলতে গেছে বোধহয়। ক্লান্ত লিকাই দেখে যে বাড়িতে মাংস রান্না করে রাখা আছে। এতটাই সে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিল যে গোগ্রাসে খাবারটা সে খেয়ে ফেলে। খাওয়া হয়ে গেলে অভ্যাসমতো সে বাড়ির পিছনদিকে যায় পানগাছ থেকে পানপাতা পারতে। খাবার পর একটা পান না খেলে লিকাইয়ের চলতো না। পানগাছের পাশে সে দেখে একটা বাচ্চার কাটা আঙুল পরে আছে। সে বুঝতে পারে যে ঐ আঙুলটা আর কারও নয়, তার মেয়েরই। তারপর তার একটু দূরেই সে তার মেয়ের থেঁতলানো মাথাটাও খুঁজে পায়। এবার তার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে তার অনুপস্থিতিতে তার মেয়ের সঙ্গে কী হয়েছে এবং এইমাত্র সে যে মাংসটা খেল সেটা আসলে তার নিজের মেয়েরই!

নিজের অজান্তেই নিজের মেয়ের মাংস খেয়ে নিল – এই ভাবনায় পাগল হয়ে গিয়ে লিকাই হাতে একটা কুঠার তুলে নেয়, দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে, অবশেষে একদম খাদের ধরে এসে পৌঁছায় সে। রাগ আর দুঃখের তীব্রতায় ক্ষতবিক্ষত লিকাই একটুও না ভেবে ঝাঁপ দেয় সোজা নিচে। এটা সেই একই জায়গা যেখান থেকে দুধসাদা জলরাশি জলপ্রপাত হয়ে নেমে এসেছে নিচে। এটা সেই একই জায়গা যেখানে দুর্ভাগা লিকাইয়ের জীবনে নেমে এসেছিল অভিশাপের কালো ছায়া। তাই লিকাইয়ের নামেই এর নামকরণ হয় নোহকালিকাই।