আশির দশকের শেষ দিকে ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখার মাঝে লাঞ্চ টাইমে গেট পাস নিয়ে মোহনবাগান গ্রাউন্ডে যাচ্ছি লাঞ্চ সারতে আমি, বাবা আর বাবার এক বন্ধু। বাবার সেই বন্ধুর হাতে পকেট রেডিও আর তাতে লাঞ্চ অবধি খেলার বিশ্লেষণ চলছে। ইডেনের সতেরো নম্বর গেট থেকে মোহনবাগান তাঁবুতে চিকেন স্টু আর সেঁকা পাউরুটির সাথে যে কণ্ঠ সঙ্গ দিয়েছে আমাদের তিনি হলেন রেডিওর ওপারে থাকা অজয় বসু। শুধু সেই দিন নয়, গ্রীষ্মশেষে প্রাক-বর্ষার দুপুরে কলকাতা ময়দানের ফুটবলের অনেক ম্যাচের ধারাভাষ্য শুনেছি ঐ সুললিত কণ্ঠে। প্রথম বর্ষার বৃষ্টিতে যেভাবে ছাদ ভিজত, তেমনই কানে বর্ষিত হত এক আকর্ষণীয় কণ্ঠ। শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গী, উচ্চারণ এবং মাঠের খেলাকে কীভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে হয় নিজের মাতৃভাষায় তা অজয় বসুর চেয়ে ভাল কেউ জানতেন না। রেডিওতে বার পোস্টের কত ইঞ্চির ওপর দিয়ে গোল মিস গেল কিংবা স্লিপে কত দ্রুততার সাথে বল ফিল্ডারের তালুবন্দি হল তার সূক্ষ্ম বিবরণ কানে পৌঁছে দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা রাখতেন সদ্য শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া প্রবাদপ্রতিম ধারাভাষ্যকার অজয় বসু।
রেডিওতে ধারাবিবরণীর সূত্রপাত ধরা যেতে পারে তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে। সেই সময়ে প্রবাদপ্রতিম আকাশবাণীর আর এক পথিকৃৎ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ধারাভাষ্যের চেষ্টা করেছিলেন। একবার এক ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে তিনি করে ফেললেন এক কেলেঙ্কারি। গোলের দিকে মারা একটি বল গোলকিপার ধরেছেন আর সেখানেই বীরেনবাবু বলে উঠলেন হ্যান্ডবল। যখন তাঁকে তাঁর সহধারাভাষ্যকার শুধরে দিতে চাইলেন তখনও তিনি অনড়। গোলকিপারের হাতে ধরা বল যে হ্যান্ডবল নয়, তা বুঝতেই বীরেনবাবুর অনেকটা সময় লেগে গেল। এরপরেও আরও কিছু কাজ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, তবে এই শিল্পের থেকে তিনি কিছুটা সরে আসতে থাকলেন। চল্লিশের দশকে ধারাবিবরণীর চেষ্টা করা হয়েছিল কিছু খেলোয়াড়কে দিয়ে ঠিকই, কিন্তু সেই সব প্রয়াস তেমনভাবে সফল হয়নি। অজয় বসু লিখছেন, ‘ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ম্যাচ রিপোর্টিংয়ের ধরন ছিল ঘড়ির কাঁটাকে হিসেব রেখে কোন সময়ে কী ঘটল, গোল হল কখন, কতক্ষণে একজন শতকের সীমানা পেরিয়ে গেলেন— শুধু যেন তার বিবরণ দাখিল করা। অনেকটা হিসেবের খাতা লেখার মতো। তাতে না থাকত বিশ্লেষণী মন্তব্য, না থাকত লেখকের উপলব্ধি, অনুভবের কথা এবং তাঁর দূরদৃষ্টির আভাস।’
ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের লেখায় পাচ্ছি যে, ১৯৫৭ সালে একটি ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের ধারাবিবরণী করে অজয় বসু এবং পুষ্পেন সরকার। এই জুটির ধারাভাষ্য মানুষের মন কাড়ে এবং এখান থেকেই শুরু হয় বাংলায় ধারাভাষ্যের সার্থক সফর। ১৯৫৯ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ভারত–অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ। সেই ম্যাচের ধারাবিবরণীর জন্য অজয় বসু, পুষ্পেন সরকারের সঙ্গে আনা হল প্রখ্যাত ক্রিকেটার কমল ভট্টাচার্যকে। এই তিন জনের রসায়ন হয়ে উঠল সুপারহিট। অজয়বাবুর কণ্ঠের মাদকতা, কমলবাবুর নাটকীয়তা আর পুষ্পেন সরকারের তথ্য সংগ্রহ। এই তিনজন পরবর্তীকালে বহু বছর ধরে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল— যে কোনও খেলার ধারাভাষ্য দিতে থেকেছেন এবং বাংলার ক্রীড়া-পিপাসু শ্রোতাদের পাড়ার রক থেকে হেঁসেল অবধি মন ভরিয়ে দিয়েছেন। বাঙালি, শ্রবণের মাধ্যমে মাঠের সকল ছবি চোখের সামনে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন দশকের পর দশক।
অজয় বসু যেমন ধারাভাষ্যকার হিসেবে সফল, তেমনই তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবেও একই রকম সাফল্য পেয়েছেন। অজয় বসু লিখছেন, ‘বয়স যখন কাঁচা ছিল, যখন শর্টস-শার্ট এবং মাঝে সাঝে পায়ে বুট গলিয়ে মাঠে- ময়দানে ছোটাছুটি করতাম, তখন গ্যালারির চূড়োয় আঁটা প্রেস বক্সটির দিকে তাকিয়ে হিংসে হত।’ তিনি যখন পরে সাংবাদিক হলেন তখন আবার নোট বই, কলম আর পেন্সিল নিয়ে ময়দানে ঘোরাঘুরি করেছেন। তিনি লিখছেন, ‘এই পেশার কল্যাণে মাঠের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। বুঝেছি যে মিথ্যের সঙ্গে গাঁটছড়া পাতা সাংবাদিকের ধর্ম নয়। সৎ সাংবাদিক মাঠের রাজারকে ফকির বানাতে পারে না। ফকিরকে রাজা সাজাতেও নয়। যেহেতু সাংবাদিকদের বিবেক বলে কিছু থাকে।’ বারবার নিজের লেখায় উনি উল্লেখ করেছেন সততার কথা। একজন সাংবাদিককে সৎ হতেই হবে এবং তার সাথে থাকতে হবে বিবেক।
বাঙালি কতটা অজয় বসুকে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মনে রাখবে জানি না! তবে তাঁর গলার ম্যাজিক আর শব্দচয়নের বিন্যাসে তিনি চিরকাল থেকে যাবেন ক্রীড়া-পাগল বাঙালির হৃদয়ে। ইস্টবেঙ্গল–মোহনবাগান ম্যাচের সময় রেডিওর জন্য হাহাকার পড়ে যেত কারণ সেখানে ম্যাচের বিবরণী দেবেন অজয় বসু এবং তাঁর দুই সাথী। গৌতম ভট্টাচার্যের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে, অজয় বসু নিজে ছিলেন মোহনবাগান সমর্থক, তবে কখনই সেটা প্রকাশ হতে দেননি তাঁর পেশায়। নিরপেক্ষভাবে তার কাজ তিনি করে গেছেন। অজয় বসু শব্দচয়নে ছিলেন তুখোড়। একটি শব্দের মধ্যে দিয়ে যে কতগুলো ছবি একসাথে প্রকাশ করা যায় তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কেউ পারতেন না।
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সমীপেষু বিভাগে সঞ্জয় চৌধুরী জানিয়েছেন: যখন টিভি ছিল না, তখন অজয় বসুর এক-একটি বাক্য এক-একটি ছবি তুলে ধরত দর্শকের চোখে। তিনি বলতেন, ‘ব্যাটসম্যান সপাটে ব্যাট চালিয়েছেন, লাল বল সবুজ ঘাসের উপর মাটি কামড়ে চলে যাচ্ছে সীমানার ও পারে।’ আমরা কল্পনায় দেখতে পেতাম বল চলে গিয়েছে বাউন্ডারির ও পারে। অথবা, ‘নৃত্যেরই তালে তালে বল করতে আসছেন রে লিন্ডওয়াল।’ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত রে লিন্ডওয়ালের বোলিং অ্যাকশন।
বিশ্বজিৎ কর লিখেছেন: অজয় বসুর সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর এখনও যেন শিহরন জাগায় প্রতি রোমকূপে! ‘ইডেনের সবুজ ঘাসে-মোড়া ময়দানের বুক চিরে বল বাউন্ডারি সীমানার বাইরে, দৃষ্টিনন্দন বাউন্ডারি হাঁকালেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ!’ কিংবা ‘হাবিবের থ্রু, শরীরের দোলায় নইমকে টলিয়ে চোখধাঁধানো ব্যাকভলি শ্যামের এবং গো-ও-ল!’ ভোলা যায় না এমন ধারাভাষ্য! বেতারে একক অভিনয়ের মতো উজ্জ্বল!
অজয় বাবু মানতেন এমন ভাষাতেই ধারাবিবরণী করা উচিত যা সহজ এবং স্বাভাবিক, দুর্বোধ্য নয়। যে ভাষায় মানুষ কথা বলে, নিজেদের প্রকাশ করে সেই ভাষাই হওয়া উচিত ধারাভাষ্যের ভাষা। উনি বিশ্বাস করতেন হোমওয়ার্কে— কিছু বলতে বা লিখতে গেলে আগে জানতে হয়, পড়তে হয়। উনি দূরদর্শন এবং আকাশবাণী দু’জায়গাতেই খেলার ধারাভাষ্য দিয়েছেন তবে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন রেডিওতে কাজ করার ক্ষেত্রে। ওনার কাছে ফুটবল ছিল ছোট গল্প আর ক্রিকেট ছিল উপন্যাস। এই দুটো খেলাতেই উনি সাবলীলভাবে খেলার বিশদ বিবরণ পৌঁছে দিতে পারতেন শ্রোতা বন্ধুদের যা, এক বিরাট প্রতিভা।
অজয় বসুর জন্ম ২রা অক্টোবর ১৯২০ সালে। সদ্য ২০২০-তে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হল। নতুন প্রজন্মের বাঙালি অজয় বসুকে কতটা চেনেন বা তাঁর কথা জানেন তা বলা কঠিন! এই সময় দাঁড়িয়ে যখন স্পোর্টস- কমেন্ট্রি পুরোটাই কর্পোরেটের ছোঁয়া আর স্মার্ট প্রেজেন্টেশনের ওপর নির্ভর করে, সেখানে এই শিল্পের পথিকৃৎরা হয়তো আড়ালে চলে যান। খেলার অবস্থান, আবহাওয়া এবং পরিসংখ্যান সব নিয়ে ছোট শব্দ বা বড় শব্দের মধ্যে সব কিছু বুনে ফেলা— এ এক শিল্পীর কাজ। এই শিল্পকে টেকনিকের মধ্যে রেখেও তার শিল্পসত্ত্বা ক্ষুণ্ণ হতে দেননি, বরং বিস্তার করেছেন।
আমরা যারা রেডিওর সঙ্গে জড়িত, তারা একটা জিনিস ভাল করে বুঝি যে শব্দ দিয়ে মানুষের মনে প্রবেশ করতে হবে এবং একটা দাগ রেখে যেতে হবে। কাজটা সহজ শোনালেও কঠিন। সেখানে গলা, বলা, শব্দ বাছাই এবং রেডিওর টেকনিক্যাল অংশটুকুও জানতে হয়। একটা জানলে আর অন্যটা না জানলে কাজে খামতি থেকে যায়। এই সবকিছু যে করতে পারে তার কাজ থেকে যায়। অজয় বসু এই সবকিছু রপ্ত করেছিলেন চেষ্টা আর নিষ্ঠা দিয়ে।
অজয় বসু ছিলেন এক আর্টিস্ট যিনি শব্দ দিয়ে চিনিয়ে দিতে পারতেন মাঠের ঘাস আর খেলোয়াড়ের ঘাম। তিনি আজও প্রবাদপ্রতিম।
ঋণ: ফিরে ফিরে চাই, অজয় বসু; গৌতম ভট্টাচার্য; সম্পাদক সমীপেষু, আনন্দবাজার পত্রিকা