অনেকদিন আগে সবুজ পাহাড় ঘেরা এক গাঁয়ে একটি ছোট্ট কাঠের বাড়িতে থাকতো এক মেয়ে। তার নাম ছিল নোয়া।
নোয়ার ঘরের পাশে একটা ফলের বাগান ছিল। তাতে আপেল গাছে লাল টুকটুকে আপেল ফলত, থোকা থোকা চেরি আর সবুজ রঙের আঙুর ঝুলত গাছ থেকে। বনের পাখিরা রোজ এসে ভিড় জমাত সেই বাগানে।
বাগানের পাশে ছিল রুমঝুম নদী আর নদীর পাড় ঘেঁষে ছিল ভারী সুন্দর এক ফুলের বাগান। অজস্র ফুল ফুটত সেখানে। রোজ সকালে কমলালেবু রঙের সূয্যি ওঠার আগেই, নোয়া সোনার কাঠি দিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শিশির রূপোর কৌটোয় তুলে নিত। তারপর বেতের ঝুড়িতে বাগান থেকে তুলে আনা ফুল নিয়ে, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে সোজা চলে যেত রাজবাড়িতে। ভোরের শিশির দিয়ে মুখ ধুয়ে ফুলের রেণু অঙ্গে মাখতেন রাজকুমারী আনিকা ।
একদিন ভোরবেলায় নোয়া সোনার কাঠি দিয়ে ভোরের শিশির তুলছিল। হঠাৎ সে দ্যাখে একটি ছোট্ট সুন্দর মেয়ে ফুলের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে! কী রূপ তার! লাল টুকটুকে আপেলের মতো গাল, চেরির মতো ঠোঁট, পরনে জুঁইফুলের জামা— তাতে চন্দ্রমল্লিকার লেস বসানো। নোয়া তো ভীষণ খুশি।
অনেক যত্ন করে মেয়েটিকে ঘরে নিয়ে এলো সে। ঘটা করে ধান-দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করে ঘরে তুলল তাকে। চামচে করে ফুলের মধু খাইয়ে দিল, নরম তুলোর বল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল আর আদর করে মেয়ের নাম রাখল শিশিরকুমারী।
ভারী মিষ্টি মেয়ে শিশিরকুমারী। সকালবেলা তার মা যখন রাজবাড়িতে যায় তখন সে জঙ্গলে খেলা করে বেড়ায়। ডোরাকাটা বাঘুমামা, হেলতে-দুলতে-আসা হাতিদাদা, ভুলো-মন ভালুক চাচা, লম্বা-দাড়ি ছাগলদাদা, লম্বা-গলা জিরাফ ভাই, সোনালি হরিণদাদা সবাই তার বন্ধু।
শিশিরকুমারীর গানের গলা বড় সুন্দর। সে যখন গান গায় তখন বনের পাখিরা গান থামিয়ে চুপটি করে তার গান শোনে, ঘেউঘেউয়ের ছানারা কুঁইকুঁই থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে, লালঝুঁটি মোরগ আর কোঁকোর-কোঁ করে না, তুলোতুলো মেঘেরা পথ ভুলে গিয়ে ওদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে, গোলাপফুলের কুঁড়িরা টুকটুক করে ফুটে গিয়ে মাথা বের করে।
এদিকে হয়েছে কী, সবুজ পাহাড়ের গায়ে এক মস্ত প্রাসাদ ছিল। সেখানে এক হিংসুটে দৈত্য বাস করত।
শিশিরকুমারীকে দেখে তার খুব ইচ্ছে হল বন্ধুত্ব করার। কিন্তু যেহেতু সে ছিল ভারী হিংসুটে সেহেতু শিশিরকুমারী যাতে আর কোথাও কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে না পারে তার জন্য একটা বুদ্ধি করল সে।
একদিন সকালবেলায় রথে চড়ে, ঝকমকে জরির পোশাক পরে হিংসুটে দৈত্য হাজির হল নোয়ার বাড়িতে। নোয়া তখন বাড়িতে নেই। দৈত্য দেখল এই সুযোগ। সে তখন ভুলিয়ে ভালিয়ে গপ্পো করতে করতে টুক করে ছোট্ট শিশিরকুমারীকে তার রথে উঠিয়ে নিল।
তারপর কত পাহাড়, কত বন, কত নদী পার হয়ে চলল সেই রথ। পথ আর শেষ হয়না! অবশেষে এক সময় রথ থামাল দৈত্য।
শিশিরকুমারীকে রথ থেকে নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘এসো শিশিরকুমারী, আমার বাড়িতে এসো। আজ থেকে তুমি কেবল আমার বন্ধু হবে, আর কারোর নয়। এই দ্যাখো, এই নীল সমুদ্রের পাশে আমি তোমার জন্য একটা নতুন প্রাসাদ তৈরি করেছি। এখানেই আমরা দুই বন্ধুতে থাকব, গল্পগাছা করব। তোমার আর কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে না। এখন তুমি চুপটি করে বোসো দেখি। কাছেই একটা জঙ্গল আছে। সেখানে অনেক হরিণ ঘুরে বেড়ায়। যাই কয়েকখানা হরিণ ধরে নিয়ে আসি। তারপর দুজনে খুব আনন্দ করে আজ হরিণের রোস্ট দিয়ে রাতের খাওয়া সারব’। দৈত্যের কথা শুনে শিশিরকুমারীর খুব কষ্ট হল। সে যে হরিণদের খুব ভালবাসে। কী করে হরিণের মাংস খাবে সে!
সে বলল, ‘আমি হরিণ খাইনা দত্যি দাদা। আর সত্যি বলছি এখন আমার মোটেই খিদে নেই। তুমি বরং আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চল’।
শিশিরকুমারীর কথা শুনে হেসে ফেলল দৈত্য। বলল, ‘এ যে বড় অদ্ভুত কথা! হরিণের মাংস এত সুস্বাদু অথচ তা তুমি খেতে চাইছ না। যা হোক, আমি বরং হরিণ শিকার করে ফেরার সময় সমুদ্র থেকে কয়েকখানা হাঙর আর তিমি মাছ ধরে আনব। ওসব ঝলসে নুন দিয়ে খেতে দিব্যি লাগবে। তুমি না হয় তাই খেও। আর শোনো, এখন থেকে তুমি আমার বন্ধু হয়ে এই প্রাসাদেই থাকবে। “মা মা” করে কান্নাকাটি করে আমাকে বিরক্ত করবে না। রেগে গেলে আমার আবার মাথার ঠিক থাকেনা’।
দৈত্য চলে গেল। শিশিরকুমারী আর কী করে!
দৈত্যের বাড়ির কাছেই একটা জঙ্গল ছিল। মনের দুঃখে সে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই জঙ্গলে চলে গেল। তারপর একটা বটগাছের তলায় বসে মায়ের জন্য কাঁদতে লাগল।
হঠাৎ কাছেই একটা সড়সড় শব্দ শুনে চমকে উঠল সে। তাকিয়ে দেখে একটা হরিণ উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে আসছে। হরিণটার গায়ে একটা বড় ক্ষত— তার থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
শিশিরকুমারী হরিণকে দেখে বলল, ‘ও হরিণদাদা, তোমার কী হয়েছে গো?’ হরিণ বলল, ‘আর বোলো না। বড় শান্তিতে ছিলাম এই জঙ্গলে, একটা হিংসুটে দৈত্য এসে সব নষ্ট করে দিয়েছে। আজ জঙ্গলে ঢুকে আমাকে ধরতে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে পালিয়ে এসেছি। দৌড়ে পালানোর সময় একটা কাঁটাগাছের গায়ে আটকে পড়েছিলাম আর তাতেই এই বিপত্তি। কিন্তু তুমি কে? তোমাকে তো কখনও এখানে দেখিনি’।
শিশিরকুমারী বলল, ‘আমি শিশিরকুমারী। ওই দৈত্য মিথ্যে কথা বলে আমাকে ওর প্রাসাদে নিয়ে এসেছে’।
হরিণ বলল, ‘তাহলে তো তোমার বড় বিপদ দেখছি’।
শিশিরকুমারী বলল, ‘সেসব কথা পরে হবে। আগে এসো দেখি, তোমার ক্ষতের চিকিৎসা করি। নিশ্চয়ই তোমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে’।
একথা বলে শিশিরকুমারী জঙ্গলে ফুটে-থাকা কিছু পপি ফুল আর ইউন গাছের পাতা তুলে নিয়ে এল। তারপর অনেক যত্ন করে হরিণের গায়ে সেই ফুলের মধু আর পাতার রস লাগিয়ে দিল। হরিণের ক্ষত থেকে রক্ত-পড়া বন্ধ হয়ে গেল। খুব আরাম হল তার।
কৃতজ্ঞতায় হরিণের চোখে জল এসে গেল। সে বলল, ‘তুমি খুব ভাল মেয়ে শিশিরকুমারী। কত মায়া দয়া তোমার মনে। তোমাকে আমি কিছুতেই এই নিষ্ঠুর দৈত্যের কাছে থাকতে দেব না। তুমি এখনই আমার পিঠে উঠে বস। আমি গোপন পথ দিয়ে তোমাকে এই জঙ্গল থেকে অনেক দূরের সবুজ বনে নিয়ে যাব। দৈত্য তোমাকে আর খুঁজে পাবে না। নাও, আর দেরি কোরো না। বেশি দেরি হলে দৈত্য এসে পড়বে’।
হরিণের কথা শুনে শিশিরকুমারী ওর পিঠে উঠে বসল। আর হরিণ তাকে নিয়ে জঙ্গলের গোপন পথ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
সবুজ বনের সব পশুপাখিরা সবাই এখন শিশিরকুমারীর বন্ধু। লম্বা-গলা জিরাফদাদা, খ্যাঁকখ্যাক খ্যাঁকশিয়াল, ল্যাজে লালছোপ বুলবুলি— সবাইকে গান শোনায় শিশিরকুমারী। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন ভারী আনন্দে কাটে তার। কিন্তু বেশিদিন এমন আনন্দ করে থাকতে পারল না সে।
একদিন সকালে রোজকার মতো খেলা করছিল শিশিরকুমারী।
হঠাৎ দেখল তার সঙ্গে জঙ্গলে আর কেউ খেলতে আসেনি। একটু অবাক হলো শিশিরকুমারী। চারিদিক কেমন যেন শুনশান, নিস্তব্ধ। গাছে ফুল নেই, ফল নেই, পাতা নেই। ঘাসে সবুজ রং নেই।
কাঠবেড়ালী কুটকুট ব্যস্ত হয়ে বাদাম নিয়ে বনের পথ ধরে যাচ্ছিল। শিশিরকুমারী তাকে বলল, ‘ও কুটকুট দাদা, এতো তাড়াতাড়ি চললে কোথায়? আর বনে আজ কাউকে দেখছি না যে!’ কুটকুট তো অবাক! চোখ গোলগোল করে বলল, ‘ওমা, জানো না বুঝি, শীত আসছে যে, এখন তো আমরা সবাই যে যার গর্তে থাকব, কেউ বেরোবো না বাইরে! এখন চারিদিক বরফে ঢেকে যাবে, তাই তো খাবার জোগাড় করে রাখছি। ছ’মাস ধরে নিজেরা খাব এবং বাচ্চাদের খাওয়াব’। কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি ল্যাজ উঠিয়ে পালাল কুটকুট।
যেই না বলা অমনি তুলোর বলের মতো বরফ পড়তে শুরু করল আকাশ থেকে। কী ঠান্ডা! কী ঠান্ডা! অত শীতে খুব কষ্ট হচ্ছিল শিশিরকুমারীর, মায়ের কথা মনে পড়ে কান্না পাচ্ছিল তার। তাই কী আর করে সে। মনের কষ্টে, সে দুঃখের গান গাইতে শুরু করল তখন। কুটুরকুটুর ইঁদুর ও পথ দিয়ে যাচ্ছিল, অমন দুঃখের গান শুনে সে থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘কেঁদো না শিশিরকুমারী। তুমি যে আমার বন্ধু। আর বিপদে বন্ধুকে আশ্রয় দেওয়াই তো কর্তব্য। তাই চিন্তা কোরো না। এই শীতে তুমি আমার অতিথি। আমার সঙ্গেই গর্তে থাকবে তুমি’।
শিশিরকুমারী ভারী খুশি হল। কুটুরকুটুর দাদার বাড়িতেই এখন থাকে সে; ঘরদোর গুছোয় আর কুটুরকুটুর দাদাকে গান শোনায়।
এভাবেই গানে গল্পে তারা দুজনে খুব আনন্দে ছ’মাস কাটিয়ে দিল। হঠাৎ একদিন কুটুরকুটুর বলল, ‘দেখ শিশিরকুমারী। বসন্ত এসেছে। সবুজ পাতা এসেছে ডালে ডালে। হলুদ ফুলে ভরে গেছে চারদিক। গাছে গাছে ফল ধরেছে। লাল লাল স্ট্রবেরি হয়েছে কত’।
কুটুরকুটুর আর শিশিরকুমারী বাইরে এসে দাঁড়াতেই দখিনা বাতাস বলল, ‘আমি এসে গেছি গো, এবার সবাই আনন্দ করো, গান গাও’। গাছের ওপর সাতরঙা পাখি বসেছিল, তাকে দেখে কুটুরকুটুর বলল, ‘কেমন আছ রঙিন ভাই। বসন্ত এসে গেল যে। এবার তো গান গাইতে হবে তোমাকে’। সাতরঙা পাখি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘তা গাইব বৈকি কুটুরকুটুর ভাই। তবে এখন নয়। বাচ্চাগুলোকে ফেলে এসেছি বাড়িতে। তাদের জন্য ভারী মন কেমন করছে। বাড়ি ফিরে ওদের সঙ্গেই গান গাইব এবার’।
সাতরঙা পাখির কথা শুনে মায়ের কথা মনে পড়ছিল শিশিরকুমারীর। কী জানি তার মা তাকে ছেড়ে কেমন আছে এতদিন ধরে!
সে বলল, ‘রঙিন দাদা, আমায় নেবে তোমার সঙ্গে? মায়ের কাছে যাব’! সাতরঙা পাখি বলল, ‘তোমার বাড়ি তো সেই পাহাড়ের গায়ে, আমার ডানায় যে অত জোর নেই বন্ধু। তবে তোমায় জাদুর দেশে পৌঁছে দিতে পারি। জাদুর দেশের মানুষেরা বড় ভাল। তুমি বললে ওরাই তোমাকে পৌঁছে দেবে তোমার বাড়িতে’।
কুটুরকুটুরকে বিদায় জানিয়ে সাতরঙা পাখির পিঠে চেপে বসল শিশিরকুমারী। মেঘের ওপর দিয়ে সাতদিন, সাত রাত্তির উড়তে উড়তে অবশেষে তারা জাদুর দেশে পৌঁছে গেল। সেখানে রাজবাড়ির ছাদের ওপরে এসে দাঁড়াল সাতরঙা পাখি।
তারপর শিশিরকুমারীকে বলল, ‘চলি গো বন্ধু, বাচ্চাগুলোর জন্য বড় মন কেমন করছে। ভয় নেই। জাদুর দেশের রাজা রাজভোগ আর রানি কমলাভোগ ভারী দয়ালু। তোমার কথা জানতে পারলে তারাই তোমাকে তোমার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। আমি এখন যাই। অনেকদিন একা আছে আমার বাচ্চাগুলো। ওদের কাছে যেতে হবে এবার’। একথা বলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল সাতরঙা পাখি!
শিশিরকুমারী আর কী করে। একাই চলল রাজবাড়িতে। রাজবাড়ি দেখে তো সে অবাক।
ওমা!!! এ যে সন্দেশের তৈরি রাজপ্রাসাদ! চারদিকে ছানার পাহাড়, ক্ষীরের সাগর, গাছে গাছে মালপো ঝুলছে, ক্ষীরকদম ফলেছে থোকা থোকা। রাজা রাজভোগ আর রানি কমলাভোগ তো শিশিরকুমারীকে দেখে বেজায় খুশি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হল অতিথিশালায়। সেখানে মাখনের বিছানায় পাটিসাপটা বালিশে লম্বা ঘুম দিল শিশিরকুমারী।
বিকেলবেলা রাজকন্যা চমচম তাকে নিয়ে জাদুর দেশে বেড়াতে বেরল। ঘোরাঘুরি সেরে শিশিরকুমারী আর রাজকন্যা চমচম দুধসাগরে ভাল করে স্নান করল তারপর এসে বসল মিহিদানা গাছের নীচে।
কিন্তু ওমা!! দুধসাগরের ওপারে কী? ভারী সুন্দর তো!! চকোলেটে মোড়া রাস্তাঘাট, গাছে গাছে থোকা থোকা লাল ভেলভেট কেক! শিশিরকুমারী তো অবাক! রাজকন্যা চমচমকে জিজ্ঞেস করতেই অবশ্য মুখ কালো হল তার।
বলল, ‘ও দেশের নাম আজব দেশ। ও দেশে আমরা যাই না বন্ধু, ওরাও আসে না এ দেশে। আমার বাবা রাজা রাজভোগ আর সে দেশের রাজা তিরামিসুর যে ভারী ঝগড়া’। মন খারাপ হয়ে গেল শিশিরকুমারীর। ঝগড়া, রাগ এসব কাকে বলে সে জানেই না। মনের দুঃখে গান ধরল সে।
এদিকে হয়েছে কী, সেই আজব দেশের একমাত্র রাজপুত্তুর মুজ, তার ভারী মনখারাপের অসুখ। কথা কয়না, খাবার খায় না। রাজবদ্যি ডোনাট কত ওষুধ দেয় কিন্তু কোনও কাজ হয়না তাতে। আজ শিশিরকুমারীর গান কানে যেতেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসল রাজপুত্র। মুখে হাসি আর ধরেনা তার।
রাজা তিরামিসু আর রানি পেস্ট্রি তো ভীষণ খুশি। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠানো হল মন্ত্রী ব্রাউনি আর সেনাপতি সুফলেকে। গোপন সভায় ঠিক হল শান্তির দূত পাঠান হবে রাজা রাজভোগের রাজ্যে।
পরদিনই শান্তির দূত পুডিং আর পাই শান্তির বার্তা নিয়ে চলে গেল। রাজা রাজভোগের আনন্দ আর ধরে না। রাজ্যজুড়ে মৈত্রী উৎসব শুরু হল! যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে সে দেশে নিয়ে যাওয়া হল শিশিরকুমারীকে। সেখানে তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই।
রাজা তিরামিসু একজোড়া সোনার ডানা লাগিয়ে দিলেন শিশিরকুমারীর গায়ে। দুই দেশের বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে পরীর মতো উড়তে উড়তে শিশিরকুমারী এসে পৌঁছাল সেই ছোট্ট গ্রামে, তার মায়ের কাছে।
এদিকে মেয়েকে হারিয়ে সুখ ছিল না নোয়ার মনে। সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত সে। এখন মেয়েকে ফিরে পেয়ে আনন্দের সীমা রইল না তার।
তারপর কী হল? তারপর নোয়া এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করল! সবাই সেই ভোজসভায় নিমন্ত্রিত।
এল হেলতে-দুলতে-হাঁটা হাতিদাদা, হলদে-ঠোঁট হাঁসদাদা, কুটকুট কাঠবেড়ালি, কুটুরকুটুর ইঁদুরদাদা, কঁক-কঁক মুরগি হেনিপেনি, লম্বা-দাড়ি ছাগলদাদা, ডোরাকাটা বাঘুমামা, ঘেউঘেউ আর তার ছানা কুঁইকুঁই, ল্যাজে-লাল-ছোপ বুলবুল ভাই, কিচিরমিচির শালিকদাদা— আর কত বলব। ভোজের খবর পেয়ে সাতরঙা পাখি রঙিন দাদা আর সোনালি হরিণদাদাও চলে এল ভোজ খেতে।
তারপর, হৈ চৈ, হুল্লোড়, আনন্দ। ঘেউ-ঘেউ, হালুম-হুলুম, কোঁক-কোঁক, টুই-টুই, প্যাঁকপ্যাক, কিচমিচ। তারপর? তারপর আর কী? ভোজ খেয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেল!
আর নোয়া আর তার মেয়ে শিশিরকুমারী আনন্দে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগাল।