বাবার সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়ল মোঙলি। একটু হলেই ফস্কাচ্ছিল রাতের লাস্ট লোকাল। কামরাখানা বিলকুল ফাঁকা। তারওপর মাত্র দুটো আলোই জ্বলছে। শীতরাতে বাপ-ব্যাটায় মিলে আধো-অন্ধকারে কামরার এক কোনে জানলা এঁটে গুটিসুটি বসল। হু-হু ঠান্ডায় চলন্ত ট্রেনে শীত করছে বেশ। সঙ্গে বন্ধ জানলাগুলোর একটানা ঝনঝন শব্দ।
— ‘বাবা, টিকিট তো কাটা হল না! চেকার ধরলে?’ . . . ভয় পেল মোঙলি।
— ‘টিকিট কাটতে গেলে লাস্ট ট্রেন পেতুম? বাড়ি ফেরার দফারফা। প্লাটফর্মেই রাত কাটত। তাছাড়া এত রাতে ঠান্ডার মধ্যে কোন চেকার উঠবে? খেয়েদেয়ে কাজ নেই’ . . . অভয় দিলেন বটুকরাম, মোঙলির বাবা।
কয়েক স্টেশন পার করে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন চেকারবাবু। লাস্ট ট্রেনেও চেকার! তাও এই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায়! কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়। তাড়াহুড়োয় টিকিট কাটা হয়নি, আর আজই কিনা টিটি’র খপ্পরে! কালো কোট, সাদা প্যান্ট, মাথা-মুখ মাফলার জড়ানো চেকারবাবু কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলেন। মুখখানা ভাল করে দেখাই যাচ্ছে না, অথচ বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘টিকেট?’
বটুকরাম প্রমাদ গুনলেন। কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার। তবু কামরায় সহযাত্রী কেউ নেই। নইলে অপমানের একশেষ। ‘আজ্ঞে স্যার, একটু হলেই ট্রেন মিস্ করতুম। দৌড়ে ধরেছি। নইলে ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে রাতভোর বিপদে পড়তুম। এবারের মতো মাফ করে দিন স্যার। আমি বরাবর ডিউটিফুল লোক। এই প্রথমবার, বাধ্য হয়ে . . .’ ঘাবড়ে গিয়ে অনুনয় করলেন বটুকরাম। মোঙলিরও গলা শুকিয়ে কাঠ। বাপ-ব্যাটাকে হাজতে চালান না করে দেয়!
খুব একচোট ধমক দিলেন চেকারবাবু , ‘রেলের ক্ষতি আমি একদম সহ্য করি না। গন্ধ শুঁকে টের পাই, কে বিনা-টিকিটের যাত্রী। আমিও কম ডিউটিফুল নই। এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি আপনি তেমন লোক নন। নেহাত বাধ্য হয়েই . . .। কিন্তু, আইন ইজ আইন। সুতরাং দিতেই হবে ফাইন। বড়জোর খোকাকে ছাড় দিতে পারি। বের করুন পাঁচশো’।
— ‘স্যার, অত টাকা যে কাছে নেই। সবটুকু দিলে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে দুজনকে। তবে কিছু রাখুন। রসিদ লাগবে না,’ . . . কাঁদো কাঁদো মুখ বটুকরামের।
মোঙলির কাঁচুমাচু মুখ দেখে চেকারবাবুর বোধহয় দয়া হল। আরও একপ্রস্থ বকুনি দিয়ে বললেন— ‘ঘুষ দিচ্ছেন? যতদিন চাকরি করেছি, সুযোগ থাকলেও এক পয়সা ঘুষ খাইনি। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। যান, জরিমানা মকুব। তবে এ-যাত্রা পার পেয়ে গেলেন ওই খোকার জন্য। একে বিনা-টিকিট, তায় উৎকোচ। ছেলেটা কী শিখছে, ভেবে দেখেছেন? আমিও তো বাবা’। তারপর আনমনে বললেন, ‘তবু ওরা শুনল না! ফাইন করায়, ঠেলে ফেলে দিল ট্রেন থেকে। কী অপরাধ আমার! তবু এখনও ডিউটিতে ফাঁকি নেই। সেই কোট-প্যান্ট। সেই রসিদবই . . .’, স্বগতোক্তি চেকারবাবুর।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন বটুকরাম। চেকারবাবুর শেষদিকের বিড়বিড়ানি কানেই ঢুকল না। বিগলিত হাতখানা বাড়িয়ে দিলেন, ‘থ্যাঙ্কিউ স্যার . . . থ্যাঙ্কিউ। এমন গলতি আর হবে না। ছেলের দিব্যি’।
প্রত্যুত্তরে কোটের পকেট থেকে এগিয়ে এল চেকারবাবু হাতখানা। মানুষের নয়, আস্ত কঙ্কালের। মুহূর্তে ভিরমি খেয়ে মূর্ছা গেলেন বটুকরাম। শীতরাতের ভারি বাতাসে চলন্ত ট্রেনের কামরা থেকে ছিটকে আসছে মোঙলির আর্তচিৎকার . . .
বটুকরাম চোখ মেলে দেখলেন, তাকে ঘিরে কয়েকটা উদ্বিগ্ন মুখ। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আর মোঙলি? ছেলেটা কোথায় গেল! সব কিছু মনে পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন বটুকরাম, ‘আমি কোথায়? ছে . . . ছেলেটা?’
— ‘আপনি কারসেডে। ছেলে ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না। এখন একটু সুস্থ লাগছে? জল খাবেন?’
বোতলখানা এগিয়ে দিলেন একজন। ধাতস্থ হয়ে ধকধক করে জল খেলেন বটুকরাম। খানিক জামাও ভেজালেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে— ‘এখানে কীভাবে এলাম? আপনারা কে? মোঙলি, আমার ছেলে?’
— ‘বলছি, সব বলছি। আর ভয় নেই। আমরা রেলের স্টাফ। কারসেডে নাইট ডিউটি চলছে। আর ওই যে আপনার ছেলে। গরম দুধ খেয়েছে। এখন একদম চাঙ্গা। তবে মশাই যাই বলুন, ওইটুকু হলে কী হবে, পুঁচকের নার্ভ বেশ শক্ত! ওর মুখ থেকেই শুনেছি সবটুকু। আপনি জ্ঞান হারাতে বেচারা বেজায় ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সামলে নিয়েছে। অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে, চেঁচিয়েও কারও সাড়া মেলেনি। এত রাত্রে শুনবেই বা কে? শেষমেশ বুদ্ধি করে কামরায় লেখা আপৎকালীন নম্বরে ফোন, আপনার মোবাইল থেকে। ট্রেন ততক্ষণে রানাঘাট প্লাটফর্ম ছেড়ে কারসেডের দিকে। ড্রাইভার সাহেব খবর পেয়ে আপনাদের উদ্ধার করেন। আমরাও চলে আসি। রেল হাসপাতালের ডাক্তারবাবুও দেখে গেছেন দুজনকে। ব্লাড প্রেসার বেশি ছিল। ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন চিন্তার কিছু নেই। আর সব শুনে বল্লেন, সাহসিকতা পুরস্কারের জন্য রেলের কাছে সুপারিশ করবেন আপনার ছেলের নাম’। নাগাড়ে বলে গেলেন কারসেডের বড়বাবু।
ছেলেকে দেখতে পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত বটুকরাম। মোঙলি পায়ে পায়ে বাবার কোলঘেঁষে বসল। মুখখানা শুকনো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বটুকরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল, ব্যাপারটা আপনারা কিছু জানেন?’
‘জানি। মানে লোকমুখে শুনেছি। আপনার আগেও কারও কারও এ-দুরবস্থা হয়েছে। তবে প্রাণ যায়নি কারও। বছর-দুয়েক আগে শিয়ালদা মেন লাইনের এক টিকিট চেকারকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মারে একদল ছোকরা। তারা বিনা টিকিটে চড়েছিল। টিকিট চাইতে কথায় কথায় বচসা বাড়ে। জরিমানা করায় ছোটলোকগুলো আরও খেপে যায়। অকথ্য গালিগালাজ, চড়-থাপ্পড়। চেকারবাবুও দমবার পাত্র নয়। আরপিএফ্ কল করে একটা ছেলেকে টেনে ধরে রাখে। অথচ কামরার প্যাসেঞ্জার, সব মজা দেখছে। কেউ এগিয়ে আসে না। তখন গুন্ডাগুলো সঙ্গীকে ছাড়াতে ধাক্কা মেরে লাইনে ফেলে দেয় চেকারবাবুকে। স্পট ডেড—’ বললেন বড়বাবু। আরও বললেন, ‘ওই চেকারবাবুর খুব সুনাম ছিল রেলে। কখনও ঘুষ নিতেন না। নায্য টিকিট না থাকলে হয় ফাইন, নয়তো সোজা লকআপ। খুব কড়া, কানুন-মানা লোক। এমনকি স্টুডেন্ট হলেও ছাড় নেই। সোজা কথা— রেলের স্টুডেন্ট কনসেশনের সুবিধা আছে কী করতে। আর সেই সততাই কাল হল। ডিউটি করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ গেল মানুষটার। তারপর থেকেই এসব ঘটছে মাঝেমধ্যে। বিশেষ করে বেশি রাতের দিকে, ফাঁকা ট্রেনে। বিনা টিকিটের যাত্রী পেলেই মওকা বুঝে ভয় দেখায়। খালি কামরায় টুপিতে মুখ ঢেকে বসে থাকতেও দেখেছে কেউ কেউ। পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে। যদিও সবটাই শোনা কথা। তবে, সবটাই যে মিথ্যে নয়, আজ হাতে-গরম সাক্ষী পাওয়া গেল!’— বলে, নিজের অফিসঘরে ফিরে গেলেন বড়বাবু।
বটুকরাম ছেলেকে আদর করে বললেন, ‘তোর মা বলে, তুই নাকি বীরপুরুষ। সত্যিই তুই বীরপুরুষ! রবি ঠাকুরের বীরপুরুষ! ভাগ্যি খোকা ছিল আমার সাথে . . . !’