Categories
পুরাণপাড়া |

যাজ্ঞবল্ক্য

808 |
Share
| ১ মার্চ, ২০২২
ক্ষেত্রেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

যাজ্ঞবল্ক্য জনক রাজাকে উপদেশ দিচ্ছেন; তামিলনাড়ুতে প্রাপ্ত। চিত্রঋণ: Wikipedia

প্রাচীনকালে যাজ্ঞবল্ক্য নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ব্রহ্মরাত বা দেবরাত। যাজ্ঞবল্ক্য বৈশম্পায়ন মুনির কাছে যজুর্বেদ শিখেছিলেন। উনি অল্প বয়সেই বেদে পরম পণ্ডিত হয়ে পড়েন। ওঁর মধ্যে শুধু পাণ্ডিত্য ছিল না, উনি একজন বড় মাপের তপস্বী ও যোগীও ছিলেন। সে সময়ে যজুর্বেদে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ (অর্থাৎ মন্ত্রের ব্যাখ্যা) ভাগ এক সঙ্গে মেশানো থাকত। তাতে লোকেদের খুবই অসুবিধা হত। উনি সেই জন্য যজুর্বেদে মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণভাগ আলাদা করে ফেললেন। এইভাবে তিনি যজুর্বেদের যে সংস্করণ করলেন, তার নাম হল শুক্ল যজুর্বেদ। কথিত আছে যে, যাজ্ঞবল্ক্য মুনি সূর্য্যের আরাধনা করে তাঁর কৃপা লাভ করেন এবং তাতেই এই কাজ করতে পারেন।

যাজ্ঞবল্ক্য খুব বড় একজন পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু একজন মানুষ জগতের সবকিছু কখনওই জানতে পারে না। যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানী হন, তাঁরা নিজেদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা বুঝতে পারেন এবং অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে উৎসুক থাকেন। আর অল্পজ্ঞানী মূর্খরা নিজেদের সামান্য জ্ঞানের অহঙ্কারে কারও কাছে মাথা নিচু করতে চায় না। যাজ্ঞবল্ক্য নিজের শক্তি বুঝতেন, অথচ তিনি যেটা জানেন না সেটা অন্যের কাছে শিখতে উৎসুক থাকতেন সবসময়। একবার যাজ্ঞবল্ক্য এবং আর কয়েকজন ব্রাহ্মণের কাছে জনক রাজা উপস্থিত হয়ে অগ্নিহোত্র সম্বন্ধে এক প্রশ্ন করলেন। ব্রাহ্মণরা সকলেই নিজ নিজ জ্ঞান অনুসারে উত্তর দিলেন, যাজ্ঞবল্ক্যও উত্তর দিলেন এবং তাঁর উত্তরই সবচেয়ে ভাল হল; কিন্তু আর কারও উত্তর ঠিক হল না। জনক রাজা যাজ্ঞবল্ক্যের সুখ্যাতি ক’রে এবং তিনি কী কী জানেন না, সে বিষয়ে আভাস দিয়ে, সেখান থেকে চলে গেলেন। ক্ষত্রিয় রাজার কাছে হেরে গিয়ে ব্রাহ্মণরা ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন এবং তাঁকে পুনরায় তর্কে ডেকে হারাতে চাইলেন। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য ব্রাহ্মণদের বুঝিয়ে নিজে বিনয়ের সঙ্গে জনকের কাছে গেলেন অগ্নিহোত্র সম্বন্ধে নিজের অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে সম্পূর্ণ করতে। রাজা তাঁকে উপদেশ দিলেন।

যাজ্ঞবল্ক্য জ্ঞান চাইতেন, বিজয় চাইতেন না, কিন্তু তর্কে তিনি যেমনভাবে জিততেন, সেই সময়ে আর কেউ তেমনভাবে জিততে পারতেন না। শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের বিষয়ে যখন সভায় বিচার হত, অন্য কেউই তাঁকে হারাতে পারত না। এইজন্য জনক রাজা তাঁকে বড়ই ভালবাসতেন এবং অনেক ধনসম্পদ দিতেন। একবার জনক তাঁর এক যজ্ঞের সভায় উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে বললেন, ‘আমি এক হাজার গরু দিচ্ছি, আপনাদের মধ্যে যাঁর সবচেয়ে ব্রহ্মজ্ঞান বেশি, তিনি গ্রহণ করুন।’ মুনিদের কারও কিন্তু তা নিতে সাহস হল না। যাজ্ঞবল্ক্য বিচারে বহুবার দেখেছিলেন যে, অন্য মুনিদের জ্ঞান তাঁর চেয়ে অনেক কম। সেইজন্য নিজের শিষ্যকে বললেন গরুগুলো নিয়ে যেতে। অন্য মুনিরা ক্রোধে জ্বলে উঠে বললেন, ‘আপনার কি আমাদের সকলের চেয়ে ব্রহ্মজ্ঞান বেশি?’ যাজ্ঞবল্ক্য খুব বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমি ব্রহ্মজ্ঞানীর পায়ে প্রণাম করি। কেবল গরুর প্রয়োজন আছে বলেই এগুলো নিচ্ছি।’ কিন্তু এ কথায় যাজ্ঞবল্ক্য নিস্তার পেলেন না। অশ্বল, জারৎকারব, আর্ত্তভাগ, ভুজ্যু, লাহ্যয়নি, উষস্ত, চাক্রায়ণ, কহোল, কৌষীতকেয়, গার্গী, বাচকবী নামে এক বিদুষী নারী, উদ্দালক আরুণি নামে যাজ্ঞবল্ক্যের নিজের এক গুরু এবং বিদগ্ধ শাকল্য নামে এক দাম্ভিক ব্রাহ্মণ তাঁকে অনেক প্রশ্ন করলেন। যাজ্ঞবল্ক্য সবগুলোরই খুব ভাল উত্তর দিলেন। সভামধ্যে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল।

যাজ্ঞবল্ক্য নিজে এক বড় যোগী ছিলেন। তিনি জীবনে অনেক ধন উপার্জন করেছিলেন। কিন্তু পৃথিবীর ভোগের বাসনা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলেন। যাজ্ঞবল্ক্যের দুই স্ত্রী ছিলেন— মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী। কাত্যায়নীর বুদ্ধি ছিল সাধারণ স্ত্রীলোকের মতো এবং তিনি সংসারের কাজ-কর্মই শুধু বুঝতেন। কিন্তু মৈত্রেয়ী ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমতী এবং যাজ্ঞবল্ক্যের মতো তাঁরও প্রবল জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ছিল।

সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়ার সময় যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীর কাছে গিয়ে বললেন, ‘মৈত্রেয়ী! আমি আমার সব ধন তোমার ও কাত্যায়নীর মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছি, আমি সন্ন্যাস নিয়ে চলে যাব।’

মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যদি আমি পৃথিবীর সব ধন পাই, তাহা হইলে কি অমর হতে পারব?’
ঋষি উত্তর দিলেন, ‘না।’
মৈত্রেয়ী তখন বললেন, ‘তবে আপনি আমাকে এমন অসার বস্তু দিচ্ছেন কেন? আপনার যে অমূল্য জ্ঞান-রত্ন আছে, তার কিছু ভাগ দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন।’
তখন ঋষি খুব আনন্দের সঙ্গে মৈত্রেয়ীকে ব্রহ্মজ্ঞান দিলেন।

যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আত্মজ্ঞানের বিষয়ে যে উপদেশ দিয়ে গেলেন, সে উপদেশ অমর হয়ে রয়ে গেল।

ঋণ: শিশুভারতী