Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

স্পঞ্জ

612 |
Share
| ৭ মার্চ, ২০২২
প্রদীপ কুমার পাল

চিত্রঋণ: Wikipedia

সমুদ্রে যত রকমের বিস্ময়কর পদার্থ আছে, তার মধ্যে স্পঞ্জ অন্যতম। স্পঞ্জ অত্যন্ত নিরীহ, সরলতম প্রাণী। প্রাণ আছে, কিন্তু চলতে পারে না। মুখ নেই, কিন্তু খাদ্য গ্রহণ করে। চোখ নেই, কিন্তু অনুভবে দেখে; সাধারণ জীবদেহে যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে, স্পঞ্জের কিন্তু তেমন কিছুই নেই, অথচ বৃদ্ধি আছে, বংশবিস্তার আছে, দেহের বর্ণে বৈচিত্র্য আছে, গঠনগত পার্থক্যও আছে স্পঞ্জের।

বিজ্ঞানীদের ভাষায় স্পঞ্জকে বলা হয় Porifera। শব্দটি দুটি ল্যাটিন শব্দ দিয়ে গঠিত হয়েছে, pore শব্দটির অর্থ ছিদ্র, fero শব্দটির অর্থ ধারণ করা। অর্থাৎ Porifera শব্দটির অর্থ হল যে প্রাণীর দেহ ছিদ্রময়। স্পঞ্জের সারা দেহের মধ্যে অজস্র ছিদ্র আছে আর এই ছিদ্র দিয়ে জল প্রবেশ করে। ছিদ্রপথে এমন কিছু মিহি সুতোর মতো দাঁড়া আছে যেগুলো জল টেনে নিয়ে শরীরের ভিতরকার জালিপথ দিয়ে বের করে দেয়। জলের সঙ্গে প্রবেশ করে খাদ্যবস্তু ও অক্সিজেন।

এখন প্রশ্ন স্পঞ্জ কোথায় হয়? স্পঞ্জের বিস্তার বিশ্বজোড়া। স্পঞ্জের সংসার অগভীর সাগরমুখ থেকে গভীর সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত। তবে স্পঞ্জের অনুকূল সংসার হল সাগরের তীর দিয়ে পাষাণময় বা শক্ত তলভূমি ও প্রবাল প্রাচীরের ভিতরে শান্ত জলের লেগুন। প্রায় ২০০০ প্রজাতির স্পঞ্জের সন্ধান পাওয়া গেছে এখনও পর্যন্ত।

স্পঞ্জ নিজে চলনে অক্ষম হলেও অন্য প্রাণীকে আশ্রয় করে চলাচল করে থাকে। সচল প্রাণীর পিঠে স্পঞ্জ থাকে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা স্পঞ্জকে পিঠে নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্পঞ্জ অন্য প্রাণীকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। একধরণের কাঁকড়া আছে যারা শামুকের খোলের ওপর স্পঞ্জের একটু টুকরো বসিয়ে খোলের মধ্যে আশ্রয় নেয়। স্পঞ্জ চলমান বাহন পেয়ে খাদ্য সংগ্রহের অতিরিক্ত সুবিধা পায়। কাঁকড়া জলের মধ্যে চলাফেরা করে, তাতেই স্পঞ্জের খাদ্য মিলে যায়। ভূমধ্যসাগর, পশ্চিম ভারতীয় সাগর, জাপান ও ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জের কাছে সবথেকে ভাল স্পঞ্জ জন্মায়।

সাগর উপকূলে ২০০ ফুট গভীরতার মধ্যে স্পঞ্জ সংগ্রহের জন্য প্রাচীন পদ্ধতি চালু আছে। স্পঞ্জ সংগ্রাহকদের বলা হয় হুকার। ছোট ডিঙিতে করে হুক নিয়ে এরা নির্মল স্বচ্ছ জলের তলায় স্পঞ্জের সন্ধান চালায়। স্বচ্ছ জলে ২৫ এমনকী ৩০ ফুট পর্যন্ত নিচের জলতল দেখতে পাওয়া যায়। স্পঞ্জ নজরে পড়লে দণ্ড নামিয়ে হাল্কা টানে স্পঞ্জগুচ্ছ তার ভিত্তিমূল থেকে টেনে তুলে নেয়। জল নির্মল এবং সমুদ্র শান্ত থাকলে তবেই এ পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে। বাহামা, কিউবা, তুরস্ক এবং মাইকোস দ্বীপের সাগর অঞ্চলে কেবলমাত্র হুকাররাই স্পঞ্জ সংগ্রহ করতে পারে।

প্রাণীদের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না থাকলেও স্পঞ্জ প্রাণবান উদ্ভিদ-প্রাণী। তাই স্পঞ্জের জন্ম, বৃদ্ধি, মৃত্যু আছে। স্পঞ্জ যখন সাগর থেকে তোলা হয়, তখন সেগুলি জীবন্ত যদিও সাধারণ প্রাণীর মতো তাদের প্রাণের লক্ষণ বোঝা যায় না। জীবন্ত স্পঞ্জের গায়ে পাতলা রঙের একটা প্রলেপ থাকে, সেইটি তার সজীবতার লক্ষণ। স্পঞ্জ তুলে নিয়ে নৌকার ওপর কিংবা উপকূলে চৌবাচ্চায় সেগুলো কয়েকদিন ফেলে পচানো হয়। গায়ের রঙের প্রলেপ উঠে গেলে যে কোমল অস্থি থেকে যায়, সেইটি ব্যবহারযোগ্য স্পঞ্জ। তারপর রোদে শুকিয়ে নিয়ে বিভিন্ন আকারে সেগুলো কেটে নানা কাজে ব্যবহারের উপযোগী স্পঞ্জে রূপান্তরিত করা হয়।

স্পঞ্জকে বলা যায় একটি সামুদ্রিক ফসল। ভূমির ওপর মানুষ যেমন বিভিন্ন পরিবেশে জলবায়ু ও ভূমি উর্বরা অনুসারে নানা ফসল উৎপন্ন করে, বিভিন্ন দেশের সমুদ্র উপকূলে তেমনি স্পঞ্জ উৎপাদনের অনুকূল ক্ষেত্রে এই জলজ ফসল চাষের ব্যবস্থা হয়েছে।