বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয়।
শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।
আজ সুরেন্দ্রনাথ করের কথা।
জোড়াসাঁকো বাড়ির ‘বিচিত্রা’য় এসেছে অল্পবয়সি ছেলেটি। সে আর্ট স্কুলের ছাত্র নয়। ছবি আঁকা শেখে অবনীন্দ্রনাথের কাছে। তাকে দেখতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি পূব বাংলায় এর আগে কোনোদিন গিয়েছ কি?’ প্রশ্ন করেই তিনি আর অপেক্ষা করেননি উত্তরের জন্য। নিজেই বললেন, ‘আমি যাচ্ছি, কুষ্টিয়া হয়ে শিলাইদহে— সেখানে থাকব কয়েকদিন, তারপর বোটে করে পদ্মায়। তুমিও যেতে পারো আমার সঙ্গে।’
কবি জানতেন, সে এক তরুণ শিল্পী। তার দাদা হলেন নন্দলাল। নন্দলালকে সে ডাকে নতুনদা। সেই নতুনদা যখন লেখাপড়া শেখার জন্য কলকাতায় এলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন তার এগারো বছরের পিসতুতো ভাইটিকে। নন্দলাল তাকে সোজা নিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। দূরদর্শী অবনীন্দ্রনাথ, জহুরির চোখ তাঁর। তাকে পরামর্শ দেন, ‘দাদার মতো ছবি-আঁকার লাইনে ঢুকে পড়ো! দেখবে ভাল লাগবে।’ শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ নিজেই তাকে ছবি আঁকা শেখান। সেই সময়ে আঁকা তার বেশ কিছু ছবি তৎকালীন বড়লাট লর্ড কারমাইকেল কিনেছিলেন। একটি ছবির শিরোনাম ছিল ‘কমরেড’। মুগা কাপড়ের উপর ব্রাশের লাইনে সামান্য রঙের ছোঁয়ায় আঁকা সাঁওতাল পুরুষ ও তার সঙ্গিনীর ঘরে ফেরার ছবি। ‘কমরেড’ নামের সেই ছবিটি রীতিমতো সাড়া ফেলেছিল শিল্প-রসিক মহলে।
জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান মন্দির তৈরির সময় শিল্পকীর্তির জন্য এই দাদা-ভাইয়ের শরণাপন্ন হন। এই মন্দিরেই শুরু হল তাঁদের নিজস্ব মৌলিক কাজ। তাঁরা আঁকতে লাগলেন অজন্তার গুহাচিত্রের মতো নকশা, খোঁপায় ফুল লাগাতে মগ্ন নারীর ছবিসহ একটি নিসর্গ চিত্র। নন্দলালও সেখানে ফ্রেসকো আঁকতে পুরোদমে ব্যস্ত। হঠাৎ তাদের বাড়ি মুঙ্গের-দ্বারভাঙ্গা থেকে খবর এল বাবা অসুস্থ, ফলে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন নন্দলাল। ‘নতুনদা’র অসমাপ্ত কাজটি তখন যত্ন করে শেষ করলেন তার ভাই, সুরেন্দ্রনাথ কর।
এমন এক তরুণ শিল্পী সুরেনের চোখে স্বপ্নের মায়া তৈরি করে দিয়ে কবি সেদিন বলেছিলেন, ‘চমৎকার জায়গা শিলাইদহ— খোলা আকাশের নিচে বোটে ভেসে বেড়াব। তোমার ভাল লাগবে।’
কবির এমন আমন্ত্রণ কি দূরে সরিয়ে রাখা যায়!
সুরেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘পরদিন নতুনদার মত নিয়ে গুরুদেবের সঙ্গ নিলুম। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়া হয়ে শিলাইদহ।’ সেখানে রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে তিন-চারদিন ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। শিলাইদহে জমিদারির কাজ মিটিয়ে কবি তরুণ চিত্রশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে বোটে গড়াই নদী হয়ে পদ্মার এক চরের ধারে নোঙর করলেন। সুরেনের যাত্রা মুঙ্গের থেকে কলকাতা হয়ে সোজা তখন একেবারে পদ্মার ওপর অবারিত আকাশের নীচে। তরুণ সুরেন্দ্রনাথ সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘পদ্মার জলরাশির বিস্তার, প্রকাণ্ড খোলা আকাশ, পদ্মার চরে ঝাউবন, জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত পদ্মার চর, আকাশ-ছাওয়া বুনো হাঁসের দল।’ সঙ্গে পদ্মায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের রঙের খেলা দেখে তাঁর শিল্পীমন অভিভূত। পূব বাংলায় ভ্রমণের দিন ফুরিয়ে এল। কবি প্রস্তাব দিলেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতনে এসো। ওখানেও এমনি খোলা আকাশের নীচে অবারিত মাঠ, খোয়াই, আশেপাশে সব সাঁওতাল আমাদের প্রতিবেশী— তোমার ভালই লাগবে।’ এও বললেন প্রয়োজনে সুরেন্দ্রনাথের বাবার অনুমতি চেয়ে কবি চিঠি লিখতেও রাজি। পরদিন নন্দলাল কবির কাছে এলে তিনি গুরুদেবের দেওয়া প্রস্তাবের কথাটা পাড়লেন। প্রস্তাব শুনে তাঁর নতুনদা তাঁকে উৎসাহিত করলেন। সুরেন্দ্রনাথ সেখানেই কবিকে জানালেন ‘শান্তিনিকেতনে যাব’।
১৯১৭ সালের জুলাই মাসে সুরেন কর যোগ দিলেন শান্তিনিকেতনে। তার আগের বছরেই অবনীন্দ্রনাথ তাঁর দুই কৃতী ছাত্র মুকুল দে আর সুরেন করকে পাঠিয়েছিলেন কাশী-সারনাথ। পরে গুরুদেবের সান্নিধ্যে এসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়ে তিনি মাদ্রাজ-পিঠাপুরম আর দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্প আর স্থাপত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। পরের বছরেই নন্দলাল বসুর সঙ্গে গিয়েছিলেন রাজগীর, নালন্দা, পাটনা, গয়া, বুদ্ধগয়া। ফলে দক্ষিণ ভারতের পাশাপাশি উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতির সঙ্গেও সম্যক পরিচিতি হয় সুরেন্দ্রনাথের। এই শিল্পবৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় তিনি গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতনের নতুন নতুন বাড়িগুলি। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, যেমন শমীন্দ্রকুটির, সত্যকুটির, সন্তোষালয়, দ্বারিক বাড়িটির দোতলা, উত্তরায়ণের কোনার্কের কথা না বললেই নয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ সহযোগিতা না করলে অবশ্য একের পর এক পরীক্ষানিরীক্ষা করা সম্ভব হত না। শান্তিনিকেতনে আশ্রমে যারা একবার অন্তত গিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মনে পড়বে সারনাথের প্রবেশদ্বারের অনুকরণে ঘন্টার দোলস্তম্ভটি। এখন তার নাম ‘পুরনো ঘন্টাতলা’।
অনুরাগীরা তাঁকে স্থাপত্যকলার দক্ষ শিল্পী হিসেবেই জানেন, কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পচর্চার পটভূমিকায় চব্বিশ বছরের সুরেন্দ্রনাথ এসেছিলেন ছোটদের ছবি-আঁকা শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে। গুরুদেব তাঁকে এই দায়িত্বই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্থির বিশ্বাস ছিল, বড়োদের মন ঘন ঘন বদলায়, তাড়াতাড়ি কপি করতে চায়, তাদের শেখাতে গেলে খুব বেশি কাজ হবে না। তাই গুরুদেব তাঁকে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, ‘আশ্রমের গাছপালা, ফুলফলের সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দাও, যেন ছোটোরা এদের পার্থক্যটা ধরতে পারে। আমগাছ-বটগাছের তফাতটা যেন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়, তারা এসব আলাদা করে আঁকতে শেখে।’
এই সময় তাঁর ছাত্র হিসেবে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে দু’জন পরবর্তীকালে চিত্রকর হিসেবে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি এবং সম্মানলাভ করেছেন। একজন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় আর অন্যজন ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মণ।
উদয়ন ও পুনশ্চ, শান্তিনিকেতন; সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সুরেন্দ্রনাথের স্থাপত্যরীতির নামকরণ করেছিলেন ‘সৌরীন্দ্রিক রীতি’
ভারতীয় শিল্পকলার সঙ্গে পরিচয় হল নিবিড়ভাবে। রবীন্দ্রনাথ চাইলেন বিদেশি শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হবেন সুরেন। ১৯২৪ সালে যখন পেরু সরকারের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ আমেরিকা রওনা হলেন, তখন সঙ্গী হলেন সুরেন। সেই সময় লণ্ডনে কিছুদিন থেকে লিথোগ্রাফ আর বই বাঁধাই শিখেছেন আর ফিরে এসেই তা’ প্রয়োগ করলেন শান্তিনিকেতন কলাভবনে। এর কয়েক বছর পরে জাভা আর বালির স্থাপত্যরীতির সঙ্গে আত্মস্থ করলেন সেখানকার মঞ্চ পরিকল্পনা, মেয়েদের সাজসজ্জা। তার সার্থক রূপায়ণ হয়েছে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন উৎসবে, নাট্য অভিনয়ে, নৃত্যকলার পরিবেশনায়। শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর সমস্ত অনুষ্ঠানে যে অননুকরণীয় শিল্পসুষমা লক্ষ্য করা জায়, তার এক নিপুণ স্থপতি ছিলেন সুরেন কর। উৎসবের বেদি থেকে অনুষ্ঠানের মণ্ডপ, ছেলেমেয়েদের সাজপোশাক থেকে উৎসব প্রাঙ্গণ, নাটকের পাত্রপাত্রী থেকে আলপনার নান্দনিক অলঙ্করণ— সব কিছুতেই ছিল তাঁর হাতের পরশ। ইন্দোনেশিয়া থেকে সুরেন্দ্রনাথ শিখে আসেন ‘বাটিক’ শিল্প। প্রথমে এর প্রবর্তন হয় শান্তিনিকেতনে। তারপরে ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সুরেন্দ্রনাথের স্থাপত্যরীতির নামকরণ করেছিলেন ‘সৌরীন্দ্রিক রীতি’। সিংহসদন, উদয়ন, পুনশ্চ, উদীচী, কোনার্ক এবং রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ বেলাকার ঘরখানি’ শ্যামলী নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে আকাশবাণী ভবন, আহমেদাবাদের অম্বালাল সারাভাই প্যালেস, অ্যাডিয়ারে অ্যানি বেসান্তের থিওসফিক্যাল সোসাইটি, ডিভিসির নগর পরিকল্পনায় এই সৌরীন্দ্রিক রীতির প্রকাশ ঘটেছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে সুরেন্দ্রনাথ ভারত সরকারের বিভিন্ন স্থাপত্য প্রকল্পের উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করেছিলেন।
আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি ছিলেন ‘পথিকবন্ধু’, ‘অন্ধকার রাত্রির তারা’। তাঁর মহত্তর কীর্তি প্রসঙ্গে কোনও প্রশস্তিই কম নয়।
তথ্যঋণঃ ১) কবির আবাসঃ সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য, সিগনেট প্রেস ২) রবীন্দ্রপরিকর সুরেন্দ্রনাথ করঃ পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় ৩)গুরুদেবঃ রানী চন্দ ৪)রবিজীবনীঃ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ