Categories
গল্পগ্রাম |

চাঁদনী

450 |
Share
| ১৫ এপ্রিল, ২০২২
শ্রমণা বসু

ঋণ: ছবি- cliparts.zone; অলংকরণ: কমলাকান্ত পাকড়াশী

ডুয়ার্সের গাছবাড়িতে দু’দিন হল বেড়াতে এসেছে ক্লাস টু-এর ছোট্ট পিউ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রকৃতির কোলে সে গরমের ছুটি কাটাতে এসেছে বাবা-মা আর দিদার সঙ্গে। এখানকার সবথেকে মজার বিষয় হল ওদের গাছবাড়ির লাগোয়া একটা ঘেরা জায়গাতেই হাতির আস্তানা। হাতিগুলো এখানকার পোষা হাতি। ৪-৫ টা হাতি আছে এখানে। ঘুরে ঘুরে হাতির জল খাওয়া, খাবার খাওয়া সবই দেখা যায়। ওদের জন্য আবার মাহুতও আছে।

এই হাতির পিঠে চড়েই তারা কাল বিকেলে ঘন জঙ্গলে ঘুরতে গেছিল। হরিণ, বাইসন, গণ্ডার, বন্য হাতি সবই দেখতে পেয়েছে তারা! গাইডকাকুর মুখে শুনেছে সে যে, তাদের ভাগ্য খুব ভাল। তাই তারা এতগুলো জন্তু একসঙ্গে দেখতে পেয়েছে। তবে একটু ভয়-ভয়ও করছিল, কারণ ওর বারবার মনে হচ্ছিল এই বোধহয় বাঘমামা ‘হালুম’ বলে গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে। দুপুরে যখন ওরা এলিফ্যান্ট সাফারিতে বেরোয়, তখন হাতির পিঠে থাকার জন্য জঙ্গলের গাছের ডালপালা ওদের গায়ে লাগছিল, খুব মজা পেয়েছিল পিউ। কিন্তু ফেরার সময় সন্ধে নামছিল, আস্তে আস্তে আলো কমে আসছিল! ওই গাছের ডালে ডালে কারা বসে আছে! এক ভয়ঙ্কর কিছুর ক্যাঁ ক্যাঁ ডাক শুনে তো গা ছমছম করে উঠেছিল পিউর! গাছের ডালগুলো গায়ে লাগতেই মনে হচ্ছিল, কে রে বাবা! মনে হচ্ছিল ওই লম্বা লম্বা লেজওয়ালা প্রাণীগুলো ঝপ করে এসে হাতির পিঠ থেকে ওকে তুলে নিয়ে যাবে বুঝি! মা বলেছিল, ‘ভয় নেই, ওগুলো তো ময়ূর! দেখ গাছের ডালে ডালে বসে আছে কতগুলো!’ পিউ তো অবাক! ওর মনে পড়ে যায়, বইতে পড়েছে সে— ময়ূর খুব সুন্দর, কিন্তু কর্কশ তার স্বর!

গাছবাড়িতে ফিরে তবে ভয় কাটে পিউর। তবে ভয়ের সঙ্গে মিলেমিশে একটা ভাললাগাও আছে। যেসব প্রাণীদের বই, টিভি আর কম্পিউটারে দেখেছে, তাদেরকে এই প্রথমবার সশরীরে দেখতে পাচ্ছে সে! পিউর আরও বেশি আনন্দ হচ্ছে হাতিগুলোর সঙ্গে একই জায়গায় থাকছে বলে! এখানে বেশ কয়েকটা হাতি আছে, একজনের নাম সূর্য, সে বেশ বড় হাতি। আরেকটার নাম লক্ষ্মণ, আবার একটা রুপালি নামের হাতিও আছে যার একটা ছানা আছে, ছোট্ট সেই ছানা হাতিটার নাম চাঁদনী।

পরেরদিন সকালে উঠেই আনন্দে আত্মহারা পিউ! চাঁদনী নামের ছোট্ট হাতিটা মাহুতদাদার সঙ্গে ফুটবল খেলছে। মাহুতদাদা ওকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে, ও পায়ে করে বল মারছে, মাহুতদাদা আবার গিয়ে নিয়ে আসছে— এটাই ওর খেলা! কী ভাল! আজ নাকি বিকেলের এলিফ্যান্ট সাফারিতে এই চাঁদনীও ওর মা রুপালির সঙ্গে সঙ্গে যাবে জঙ্গলে। আজ থেকে ওর ট্রেনিং শুরু!

পিউ মনে মনে ভাবে, চাঁদনীও ছোট, ও-ও ছোট। চাঁদনীকে যদি ও বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, পুষতে পারে! তাহলে তো বেশ মজা হয়! ওদের বাড়ির বাগানে চাঁদনী আর ও রোজ সকালে ফুটবল খেলবে। ওর বন্ধুদের এনেও ও দেখাবে চাঁদনীকে। কী ভালই না হবে! যেমন ভাবা, অমনি বাবার কাছে গিয়ে বায়না শুরু। বায়নার জের আরও বাড়তে লাগল যখন বিকেলে চাঁদনী ওদের সঙ্গে জঙ্গলে গেল! কী সুন্দর ৪ টে হাতির পিঠে ওরা কয়েকজন যাত্রী, মাহুতদাদারা রয়েছে আর চাঁদনী ওর মায়ের পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে! কী মিষ্টি!

ঘরে ফিরে প্রচণ্ড বায়না ধরল পিউ, আর মাত্র একদিন এখানে আছে ওরা, এর মধ্যেই ওর চাঁদনীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে বাবাকে! শুরু হল কান্নাকাটি, চাঁদনীকে ও পুষবেই! রেবামাসি যদি কুকুর পুষতে পারে, মামারবাড়িতে যদি ম্যাঁও (বেড়াল) পুষতে পারে, তাহলে ও কেন চাঁদনীকে পুষতে পারবে না? কিছুতেই পিউর বাবা-মা ওকে বোঝাতে পারে না যে কুকুর-বেড়াল পোষা আর হাতি পোষা এক নয়!

শেষকালে দিদা মানে পিউর প্রিয় দিদুন হাল ধরলেন। পিউর চোখ মুছিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘দেখ পিউদিদি, তোমাকে যদি চাঁদনী বলে যে তোমার মা-বাবা চলে যাক, তুমি এখানে থাকো, তুমি কি পারবে আমাদের ছেড়ে এখানে থাকতে?’
পিউ কান্নামাখা গলায় বলল, ‘না।’
দিদা বলল, ‘কেন?’
পিউ বলল, ‘মা ছাড়া আমাকে কে খাইয়ে দেবে?’
দিদা বলল- ‘একদম ঠিক! দেখ, চাঁদনীও তো ছোট্ট, তোমারই মতো! ও কী করে থাকবে ওর মাকে ছাড়া? তুমি ওর সঙ্গে খেলতে পারবে, কিন্তু ওকে খাইয়ে তো দিতে পারবে না?’
কী বুঝল কে জানে, পিউ ঘাড় নেড়ে বলল ‘না’।
দিদা আবার বলল- ‘তাহলে? শুধু খেলার জন্য তোমার বন্ধুকে তুমি এত কষ্ট দেবে বলো?’
পিউ ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে, ‘কিন্তু চাঁদনীকে দেখতে না পেলে যে আমার কষ্ট হবে খুব!’
দিদা বলল- ‘কে বলেছে দেখতে পাবে না? আমরা তো কয়েকমাস বাদে আবার আসতে পারি!’
কান্না থামিয়ে দিদার দিকে তাকায় পিহু! যেন আশার আলো দেখতে পেয়েছে।
দিদা বলে, ‘তোমার প্রিয় জ্যাঠাই, মামাদাদু, দিদিয়া এরা তো সবাই অন্য অন্য শহরে থাকে, তাদের বাড়িতে তুমি মাঝে মাঝে যাও না? কম কম দেখা হলেও দেখতে পাও তো? এখানেও তাই! আমরা মাঝে মাঝে চাঁদনীকে দেখতে আসব। দেখতে দেখতে তুমিও বড় হয়ে যাবে, চাঁদনীও বড় হয়ে যাবে। তখন তুমি নিজে নিজেও আসতে পারবে!’
দিদুনের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হল পিউ। আর কাঁদল না। পরের দিন বাড়ি ফিরে আসার সময় চাঁদনীকে ওর প্রিয় পুতুলটা দিয়ে এল পিউ আর বলল, ‘এই পুতুলটা নিয়ে খেলিস হ্যাঁ, পরেরবার তোর জন্য একটা টেডি বিয়ার নিয়ে আসব। টাটা!’ শুঁড় নেড়ে পিউকে টাটা করে চাঁদনী।