Categories
রকমারিনগর |

রেডিওর অন্দরমহল

239 |
Share
| ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী

দীর্ঘ দিন রেডিও মির্চির প্রোগ্রামিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। 'সানডে সাসপেন্স' নামক প্রখ্যাত অনুষ্ঠানটির উদ্ভাবক।

ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

আমি তখন ক্লাস নাইনে। একবার স্কুল থেকে কলকাতা-‘ক’ থেকে প্রচারিত একটি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর বেতার কেন্দ্রে যেতে হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, পাঠ্য বইয়ের বিজ্ঞানের একটা চ্যাপ্টার নিয়ে আলোচনার থেকেও যেটা মনে আছে তা হল— আকাশবাণী ভবনের এক-একটি ঘর, তার যন্ত্রপাতি, ব্রডকাস্টিংয়ের নানা সরঞ্জাম আর রেডিওর পিছনের সেই মানুষগুলোকে যাদের সঙ্গে একদিনের আলাপ। ছাত্রী হওয়ার সুবাদে আমাদের ঘুরে দেখার কিছু সুযোগ হয়েছিল। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছিলাম যে ঘরটি থেকে মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়, বা যে ঘরটিতে নাটক রেকর্ডিং হয় বা হত। সেদিন মনে হয়েছিল যে রেডিওতে সাধারণ শ্রোতা আমরা, শুধুমাত্র একজনের গলা শুনি বা গান শুনি, কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলি তৈরি হওয়ার পিছনে তো একটা আয়োজন থাকে!

আমার এম.এ পড়া যখন প্রায় শেষ, চাকরি খুঁজতে বেরব, এরকম এক সন্ধিক্ষণে আমাদের দেশের প্রাইভেট এফএম রেডিওর আবির্ভাব হয়, সালটা ১৯৯৪। খানিকটা ঝোঁকের বশেই অ্যাপ্লাই করে দিই। কিন্তু না, রেডিও জকি বা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হতে নয়, আমার উৎসাহ ছিল ঐ পিছনের কর্মকাণ্ডয়। আমি প্রোডিউসার হতে চেয়েছিলাম। তারপর প্রায় ২৪ বছর রেডিওর সেই অন্দরমহলের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক।

আকাশবাণীর পুরনো দিনের অভিজাত বিল্ডিংয়ের সঙ্গে আজকের দিনের বেসরকারি রেডিও স্টেশনগুলি অনেকটাই আলাদা। চব্বিশ ঘন্টার ননস্টপ ব্রডকাস্ট, তাই প্রযুক্তি-নির্ভর তো হতেই হয়! আজকালকার কর্পোরেট অফিসগুলোর মতোই তার দপ্তর, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি। কিন্তু অফিসের মধ্যিখানের যে জায়গাটায় রেডিওর স্টুডিও, সেটার সঙ্গেই আমার মনের টান, সেটাই ছিল আমার কর্মক্ষেত্র।

রেডিও জকিরা একটানা ৪-৫ ঘন্টা মাইকের সামনে বসে কথা বলে যেতে পারেন। তোমরা ভাবতেই পারো এটা কী করে সম্ভব হয়— এত কথা, এত গান, এত তথ্য, তারপর শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা— এত কিছু কীভাবে সাজানো হয়!

খুব বড় না হলেও একটি এফএম রেডিওর প্রোগ্রামিংয়ে একটি টিম কাজ করে যার মধ্যে সাধারণত থাকে একজন প্রোডিউসার, একজন কপিরাইটার (যে সাধারণত বিজ্ঞাপন লেখার কাজ করে), একজন মিউজিক ম্যানেজার, একজন বা দু’জন সাউন্ড এডিটর বা সাউন্ড ডিজাইনার। এই টিমকে পরিচালনা করার দায়িত্বে থাকে একজন প্রোগ্রামিং হেড বা ডিরেক্টর। ছোট ছোট রেডিও স্টেশনগুলিতে অবশ্য এত ভাগ থাকে না। সেখানে রেডিও জকি দিব্যি প্রোডিউসারের কাজ বা বিজ্ঞাপন লেখার কাজ সামলে নিতে পারে এবং প্রোগ্রামিং ডিরেক্টরই মিউজিক ম্যানেজারের কাজ করেন। আর ঐ যে বললাম প্রযুক্তির একটা বিরাট ভূমিকা আছে।

যে কোনও এফএম রেডিও স্টেশনের একটা গানের লাইব্রেরি তো অবশ্যই থাকে। নয়ের দশকে আমরা সিডি লাইব্রেরি দেখেছি। কিন্তু এখন এই মিউজিক লাইব্রেরি পুরোটাই ডিজিটাইজড। কম্পিউটারের বোতাম টিপলে নিমেশে তোমার পছন্দ মতো গান বাজাতে পারবে। চব্বিশ ঘন্টা নানা স্বাদের গান, চাইলে এক মাস আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা যাবে। রেডিও জকি সেইমতো তার অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিয়ে তৈরি হতে পারবে আগে থেকেই।

এফএম রেডিও মূলত লাইভ অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট করে। মানে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই আগে থেকে রেকর্ডেড নয় এবং সেখানেই প্রোডিউসার বা মুখ্য অনুষ্ঠান পরিচালকের একটা বড় ভূমিকা থাকে।

একটু বুঝিয়ে দিই। ধরো, খুব গরমের একটা দিন, দুপুরে তুমি গান শুনছ রেডিওতে, হঠাৎ অন্ধকার করে কালবৈশাখী এল। একটা মুডের গান চলছিল তার আগে পর্যন্ত, কিন্তু ঝড় ও এক পশলা বৃষ্টির পর তোমার তো বৃষ্টির গান শুনতে ইচ্ছে করতেই পারে। একেবারে মিনিটের মধ্যে চাইলে রেডিও জকি পুরো গানের লিস্টটাই পাল্টে ফেলতে পারেন। প্রযুক্তি সাহায্য করছে ঠিকই, কিন্তু যিনি অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন তাঁর নিজস্ব রুচি, জ্ঞান, উপস্থিত বুদ্ধি, শ্রোতাদের কী ভাল লাগবে না লাগবে সেটা বোঝার ক্ষমতাই তখন মুখ্য। রেডিও জকি এবং এই প্রোডিউসার দু’জনের জুটি রেডিওকে দিতে পারে শ্রোতাদের জন্য একটি সর্বাঙ্গীণ সুন্দর অনুষ্ঠান।

ওয়ার্ক ফ্রম হোম— এই কথাটির সঙ্গে এখন আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা বলছি— প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা কীভাবে লাইভ অনুষ্ঠান বাড়িতে বসে পরিচালনা করেছি তার একটা গল্প বলি।

রোববারে লাইভ অনুষ্ঠান থাকে না বেশিরভাগ এফএম রেডিও চ্যানেলগুলিতে। এরকমই একটা রোববার ছিল ১৪ই আগস্ট, ২০১১। খবর এল অভিনেতা শাম্মি কাপুর মারা গেছেন। ১০ বছর আগের কথা— বাড়িতে বসেই রেডিও স্টেশনের সিস্টেম অ্যাকসেস করে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে গানের তালিকা মুহূর্তের মধ্যে সব পাল্টে ফেলি, সাজিয়ে দিই শাম্মি কাপুরের সবথেকে হিট গানগুলি দিয়ে।

রেকর্ডেড অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রোডিউসার বা ডিরেক্টরের ভূমিকা অনেকটাই মুখ্য। যেমন ধরো, বেতার নাটকের ক্ষেত্রে একটা বড় টিম কাজ করে— লেখক, পরিচালক, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট, সংগীত পরিচালক, সাউন্ড এডিটার— একাধিক মানুষের মিলিত প্রয়াসেই রেডিওর নাটক। তবে বেতার নাটক প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। সে প্রসঙ্গে না হয় আরেকদিন গল্প হবে! এখনকার মতো রেডিওর অন্দরমহলের কথা এখানেই থাক।