Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

বাঘরক্ষার গল্প

340 |
Share
| ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
অনিল কৃষ্ণ মিস্ত্রি

লেখক সুন্দরবনের ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার প্রিন্সিপাল ফিল্ড অফিসার

চিত্র: অনিল কৃষ্ণ মিস্ত্রি

প্রকৃতি এক অসম্ভব প্রতিভাবান জাদুকর যার বৈচিত্রময় সৃষ্টি দেখে অবাক হতে হয় সকলকেই। কিছু কিছু জায়গায় প্রকৃতি যেন একটু বেশিই ছুঁইয়ে দিয়েছে তার জাদুদণ্ডটা। এরকমই এক বৈচিত্রময় জায়গা হল বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এক বিস্ময় বনভূমি সুন্দরবন। যদিও সিংহকে বলা হয় জঙ্গলের রাজা, কিন্তু সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সিংহাসন আলো করে রেখেছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এখানে তারই রাজত্ব চলে। নদী ও জঙ্গল মিলিয়ে এই রাজত্বে বসবাস করে হরিণ, বনবেড়াল, কুমির, কামট, কাঁকড়া, নানারকম মাছ, সাপ ইত্যাদি প্রাণী। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় সমান তালে গড়ে উঠেছে জনবসতিও। মানুষ ও বন্যপ্রাণ এখানে একে অপরের পরিপূরক। আমরা যারা সুন্দরবনে জন্মেছি, এখানে বড় হয়েছি, তাদের কাছে এই জঙ্গল খুব একটা বিস্ময় নয়, এটাই আমাদের নিজেদের ঘরবাড়ি বলা যায়। কিন্তু নিজের জিনিস নিজের দায়িত্বে রাখা, যত্নে রাখার বোধ প্রথম থেকেই সকলের আসে না। আমার জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই গল্পই আজ বলব তোমাদের।

সুন্দরবনের বালিদ্বীপে আমার জন্ম। সুন্দরবনে বড় হওয়ার সূত্রে খুব ছোটবেলা থেকেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে জঙ্গলে গেছি নিয়মিত। রহস্যময় জঙ্গলের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো ছিল প্রায় নেশার মতো। জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় বড় হওয়ার জন্য বন্যপ্রাণীর দেখা পাওয়া আমাদের কাছে ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই আস্তে আস্তে হয়ে উঠল অস্বাভাবিক, শুরু হল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। কীরকম অ্যাডভেঞ্চার? বন্যপ্রাণী শিকারের অ্যাডভেঞ্চার! কখনও দিনের আলোয়, তো কখনও রাতের অন্ধকারে আমরা বন্ধুরা মিলে বেরিয়ে পড়তাম শিকারে! আমরা তখন যুবক, এক-একজন সফল শিকারী। কিন্তু একদিন ঘটল এক অবাক করা ঘটনা, যার পর থেকে আমি আর কখনও শিকারে যেতে পারিনি।

সেদিন আমরা বন্ধুবান্ধবরা জঙ্গলে গেছি, লক্ষ্য অবশ্যই শিকার। দূর থেকে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল এক মা হরিণ তার শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। শিশুটি মায়ের কোল ঘেঁষে নিশ্চিন্ত মনে দুধ খেয়ে যাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ একটা গুলি গিয়ে লাগল মা হরিণটার গায়ে। মা হরিণটা কাঁপতে কাঁপতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মা-ও কাঁপছে, শিশুটিও কাঁপছে থর থর করে! গুলিটা আমার এক বন্ধু করেছিল। কিন্তু শিশু হরিণটাকে ওইভাবে কাঁপতে দেখে আর ওর মাকে ওইভাবে মারা যেতে দেখে আমার কেমন যেন লাগল, খুব কষ্ট হয়েছিল। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমি সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এই বন্ধুদের সঙ্গে আর নয়, জীবনে আর কখনও নিজের আনন্দের জন্য কোনও প্রাণীকে হত্যা করব না, বরং এই বনের প্রাণীদের রক্ষা করব যতটা সম্ভব!

এরপর আমি সোজা চলে যাই বনদপ্তরের সেই সময়কার ফিল্ড ডিরেক্টরের কাছে। তাঁর পরামর্শেই আমি তৈরি করি এক প্রতিষ্ঠান— ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া। এই প্রতিষ্ঠান বন-জঙ্গল সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গোটা বালিদ্বীপ ও আশেপাশের মানুষদের বিভিন্ন বিকল্প জীবিকা নিয়েও ট্রেনিং দেওয়া হয় যাতে তারা শুধু বন-জঙ্গলের সম্পদ নিয়েই নয়, বিকল্প কোনও পন্থায় সফলভাবে রোজকার করতে পারে। আমি বনদপ্তরের সঙ্গে জড়িত আরও একটি কারণে। যখন কোনও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার জঙ্গল থেকে গ্রামে এসে পড়ে, তখন বনদপ্তর থেকে ডাক পড়ে আমার। বনদপ্তরের সহযোগী হয়ে আমি সেখানে যাই সেই বাঘটিকে ধরে তাকে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার কাজে সাহায্য করতে। আর এই বাঘকে তার সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে গিয়ে আমাকেও নানা ঝুঁকির মুখে পড়তে হয়েছে বারংবার, অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেক। একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়।

আমি তখন নিজের প্রতিষ্ঠানের নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হঠাৎ আমার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমি খবর পাই যে আমাদের পাশের গ্রাম সাতরকোনাতে একটা গোয়াল ঘরে দুটি বাঘের বাচ্চাকে পাওয়া গেছে হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে নিজের দলবল নিয়ে ছুঁটে যাই। শোনা যায়, এক বাঘিনী রাত্রিবেলা তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে এসে ওই গোয়ালঘরে রেখে নিজে নদী সাঁতরে জঙ্গলে চলে গেছে। বাচ্চা দুটো ওই গোয়ালঘরে বসেই একটা ছাগল ধরে খাচ্ছিল, ভোরবেলা গোয়ালঘর খুলতেই ওদের দেখা যায়। বাচ্চাদুটোর মধ্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, দুজনেই বেশ বড়, প্রায় দেড় বছরের। বোঝা গেল যে তারা প্রায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, বাঘিনী তাদের ট্রেনিং শেষ করে এইবার জঙ্গলে ছেড়ে দেবে। গোয়ালঘরে বাঘ পড়েছে শুনে গ্রামের লোকজন তখন ছুটে এসে ভিড় জমিয়েছে! এত লোকের চিৎকারে ভয় পেয়ে মেয়ে বাঘটা পালাতে গিয়ে ঢুকে পড়ল ওই গ্রামেরই দেবেন সর্দারের বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের লোকের দেওয়া জাল দিয়েই ঘিরে ফেলা হল ঐ বাড়ি। তারপর তাকে ঘুমের ওষুধের মাধ্যমে ঘুম পাড়িয়ে বনদপ্তরের নৌকোতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হল এক সেন্টারে। বাকি রইল ছেলে বাঘটা।

চারপাশের লোকেদের মুখেই শোনা গেল যে সে নাকি গিয়ে ঢুকেছে ধানের জমিতে। সদ্য ধান কাটা হয়েছে, ফলে বিভিন্ন ধানের জমিতে স্তূপীকৃত ধান! সেখানে কোথায় বাঘ? গ্রামের লোকেদের বারবার বলা সত্ত্বেও তারা ভিড় জমিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছে। সবাই বাঘ দেখতে চায়! এভাবে ভোরবেলা থেকে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল। আমরা মানুষজনদের অনুরোধও করেছিলাম যে এভাবে ভিড় জমাবেন না, একটু সহযোগিতা করুন। কিন্তু কেউ শোনেনি। তারা বাঘ দেখবেই আর বাঘ দেখতে পেলেই ছুটবে তার পেছনে পেছনে। ওদিকে এত মানুষ দেখে বাঘও ভয় পেয়ে গেছে আর ভয় পেয়ে ছুটছে প্রাণপণে! আবার আক্রমণও করেছে ছ’-সাতজনের ওপর। তাদেরকে হাসপাতালেও পাঠানো হয়েছে। বাঘের আক্রমণের ফলে মানুষজনও বেশ ক্ষেপে উঠেছে। তখন বাধ্য হয়ে আমি বনদপ্তরের কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে অসম্ভব হলেও এই ধানের জমির মধ্যেই বাঘটাকে ঘুম পাড়াতে হবে। চেষ্টা করলাম অনেকবার, কিন্তু হল না। এদিকে সন্ধে হয় হয়! এবার হঠাৎই এক সময় বাঘটাকে খুব কাছাকাছি দেখতে পেলাম আমরা, প্রায় ১০-১২ ফুটের মধ্যে! এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে! এবার আমরাও এগোচ্ছি, সঙ্গে আছেন গোপাল তাঁতি যিনি ঘুম পাড়াবেন। হঠাৎ আমাদের দিকে লাফ দিল বাঘটা! আমি পিছোতে গেলাম, কিন্তু গোপালবাবু পিছিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে গেলেন সোজা আমার পায়ের ওপর। ব্যাস! আমার পা ভাঙল! ওদিকে বাঘটাকে ওইভাবে লাফাতে দেখে নিরুপায় হয়ে একজন পুলিশ অফিসার গুলি করলেন বাঘটাকে। আমার একদম কাছাকাছি এসে পড়ল বাঘটা। গুলি খেয়ে ক্ষেপে গিয়ে বাঘটা ওঠার চেষ্টা করল, পারল না। তার পিছনের দুটো পা ভেঙে গেছে! সামনের থাবা দিয়েই সে রাগে মাটি খাবলাতে লাগল, যে মাটি এসে পড়তে থাকল আমার বুকের ওপর। উপায় না দেখে আরেকটা গুলি করে বাঘটাকে মেরে ফেলতে হল। এভাবেই গ্রামে যখনই বাঘ চলে আসে, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করি যাতে তার কোনও ক্ষতি না হয়, তাকে যেন ঠিকমতো জঙ্গলে পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তো হয়েই যায়!

আমার প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র তরফ থেকে আমি সব সময় চেষ্টা করি যাতে এখানকার মানুষ কোনও বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিয়ে স্বনির্ভর হয়। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে মধুসংগ্রহ করতে গিয়ে বা খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে কাঁকড়া খুঁজে আনতে গিয়ে কেউ কেউ বাঘের পেটে গেছে। ‘আরেকটু যাই আরেকটু যাই’ করে করে জঙ্গলের গভীরে যেতে যেতে এটা একটা নেশার মতো হয়ে যায়। বিপদসীমা অতিক্রম করে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। আমার এক মাসতুতো ভাইও এভাবেই বাঘের আক্রমণে মারা গেল গত বছর। অত ঝুঁকি নিয়ে বারবার গভীর জঙ্গলে যেতে অনেকবার মানা করেছি, কিন্তু শোনেনি। আসলে বাঘের প্রাকৃতিক ধর্মই হচ্ছে যে সে জঙ্গলে কোনও চলমান প্রাণী দেখলেই ভাবে তার শিকার বা তার খাবার। ধরো তোমার বাড়ির সামনে যদি কেউ একটা বড় মাছ রেখে যায়, তাহলে কি তুমি সেটা নিয়ে খাওয়াদাওয়া করবে না? বাঘের আক্রমণ করার ব্যাপারটাও একই!

সবশেষে সকলের উদ্দেশে এটাই বলতে পারি যে, বন্যপ্রাণীদের মতো করে তাদের থাকতে দেওয়া হোক। অযথা তাদের বিচরণক্ষেত্রে গিয়ে তাদের অসুবিধা না বাড়ানোই ভাল। টুরিস্ট হিসেবে অবশ্যই মানুষেরা আসবেন, বিপদসীমার ওপারে না যাওয়াই ভাল। কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে এসে জায়গাটাকে নোংরা করে, দূষিত করে না যাওয়াই ভাল। সুন্দরবন আমাদের সম্পদ আর তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই নেওয়া উচিৎ।