Categories
গল্পগ্রাম |

রু। তৃতীয় পর্ব

183 |
Share
| ১৩ নভেম্বর, ২০২৩
শ্যামলী আচার্য

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

(চতুর্থ অধ্যায়ের পর)

খানিক রোদ, খানিক ছায়া। রুয়ের নানী ছায়ার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিলেন। ভেড়াগুলো কাছেই চরছে। মাঝেমধ্যে ওদের দিকে খেয়াল রাখেন। দলছুট হয়ে এক-আধটা এদিক-সেদিক পালালে জোরে হাঁক দেন। ইলানা, পেতারেকের মতো ছোটরা আশেপাশেই খেলে বেড়ায়। নানীর হাঁক শুনলে তারাই ছুটোছুটি করে ধরে আনে। দু’চারটে চড়চাপড়ও দেয়। ভেড়াগুলো দুষ্টু কম নয়। ভালোমানুষের মতো মুখ করে থাকে। যেন কিচ্ছু বোঝে না। ফাঁক পেলেই গুড়গুড় করে এদিক-ওদিক দৌড়য়। অথচ তেমন সাহস নেই যে একা একা বহুদূর চলে যাবে।
নানী এইসময় বসে বসে উলের কার্পেট তৈরি করেন। আর মাঝেমধ্যে টাশ-কি বোনেন। এই টাশ-কি হল পশম দিয়ে বানানো কোনও পশু-পাখি বা মানুষের পুতুল। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখলে ভারি জীবন্ত দেখায়। নানীর হাতে তৈরি পশমি খেলনা জিনিস জুরিন শহরে নিয়ে যায়। বিদেশি অতিথিদের উপহার দেয়। অনেকেই এগুলো পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে দাম দিতে চেয়েছেন। জুরিন কিচ্ছু নেয়নি।
“বিক্রির জন্য আনিনি স্যার, আমার মায়ের নিজের হাতে বানানো। এই টাশ-কি আমার দেশের ঐতিহ্য। মেমেন্টো হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান। ঘরে পেরেকে ঝুলিয়ে রাখবেন। দেখলেই আমাদের কথা মনে পড়বে আপনার।” জুরিন হাত মেলায় তাদের সঙ্গে। তাঁরা খুশিমনে নিয়ে যান কিরঘিজস্তানের এক অখ্যাত গ্রামের হাতের কাজ।
আজ নানী কার্পেট নিয়ে খুব ব্যস্ত। সূক্ষ্ম কারুকাজের পালা শেষ। এখন সুন্দর করে চারটে ধার মুড়ে খুঁতগুলো খুঁজে মেরামত করে রাখা। জুরিন দিনদুয়েক আগে শহর থেকে খবর পাঠিয়েছে, এই গাঁয়ে ওদের বাড়িতে এক বিদেশি অতিথি এসে থাকতে চান। তাঁর স্ত্রী আর ছোট ছেলেটিও নাকি আসবে। ছোট্ট ছেলেটি রুয়ের বয়সী। স্ত্রী এই দেশেই কাজে এসেছিলেন। অনেক পড়াশোনা শেষ করে এবার তিনি নিজের দেশে ফিরবেন। তাঁকে নিতে তাঁর স্বামী আর ছেলে এসে হাজির হয়েছে। ফেরার আগে তারা তিনজনে মিলে ফারঘানা উপত্যকার এই গ্রামটিতে কিছুদিন নিরিবিলি ছুটি কাটিয়ে যেতে চান।
ভীষণ তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে। ওদের ছোট্ট কাঠের বাড়ির বাইরে একটা তাঁবুর মতো আস্তানা রয়েছে। সেটার কাঠের ফ্রেম মেরামত করে আজ সারাদিন ধরে চামড়া আর পশমের ফেল্ট দিয়ে ঢাকা চলছে। জানলা দরজায় থাকবে পশমে বোনা পাড়ের মতো পর্দা। সুতো আর উল দিয়ে বোনা দস্তরখান পেতে দেওয়া হবে খাবার জায়গায়। তার ওপরে পোর্সেলিনের পাত্রে থাকবে খাবার সাজানো। মেঝেতে আর কাঠের বেঞ্চের ওপর পাতা শোবার বিছানায় সব চাদর আর কাপড় ঝকঝকে ফিটফাট। কুশনের ওপর দারুণ রঙচঙে আর বাহারি সব ওয়াড় পরানো চলছে। রুয়ের নানী আর মা দুদিন ধরে ভীষণ ব্যস্ত। প্রতিবেশিরাও এসে কাজে হাত লাগাচ্ছে। চারপাশ তকতকে করে নিকিয়ে ধুয়ে মুছে সকলে তৈরি হচ্ছে। তাদের উত্তেজনা কী কম! এই প্রথম এই গাঁয়ে বিদেশি অতিথি আসছেন। তাঁর আপ্যায়ণ আর যত্নে যেন কোনও ত্রুটি না হয়। সকলেই ভাবছে, জুরিনের হোম-স্টে’র টানে যদি এই গ্রামে বিদেশি পর্যটক আসে, তাহলে গ্রামের আর একটু হাল ফিরবে। আরও দুয়েকজন ভাবছে, তারাও এইরকম ব্যবস্থা করে রাখবে। আগে এঁদের যত্নআত্তি করার পালা।
“রু, ইয়েনিসেই উপত্যকার ওই অংশটাতে আমার রোজ একবার চলে যেতে ইচ্ছে করে… কবে যে আমি যেতে পারব, কে জানে….” নাতালিয়ার ক্লাস থেকে বেরিয়ে আজ হাঁটছিল দু’জন। আসিমভ আর রু। আসিমভ নিজের মনেই অনেক কথা বলে। রু খুব মনোযোগী শ্রোতা। আসিমভ জানে, রু শুধু শ্রোতা নয়, রু ভাবুক। ওর ভাবনার গভীরতায় আসিমভ খুব স্বস্তি পায়।
“ইয়েনিসেই কোথায় আসিমভ? কী আছে সেখানে?”
“ইয়েনিসেই একটা বিরাট বড় নদীর নাম। সাইবেরিয়ার নদী। আর আমি সেই নদীর উপত্যকাতেই ছিলাম…”
আসিমভের কথার মধ্যেই অবাক হয়ে প্রশ্ন গুঁজে দেয় রু, “তুমি ছিলে মানে? এই যে তুমি বললে তোমার সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করে?”
“একদিন ছিলাম বলেই তো আজ আবার যেতে ইচ্ছে করে রু। বেশ মনে পড়ে আমার টকটকে ফর্সা গালের ওপর লাল চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এসে পড়ত। সুড়সুড়ি লাগত। সবজে-নীল চোখের মণিতে ছায়া পড়ত ইয়েনিসে নদীর জলের। পাইন আর লার্কের বন দেখা যায় দূরে। রেইনডিয়ারেরা দল বেঁধে চরে বেড়ায় শীতের উপত্যকায়। যাযাবর পাখির দল তখন বেপাত্তা। শীত এলেই তারা অন্য দেশের খোঁজে উড়ে যায় দল বেঁধে। কাঠের ঘর থেকে বেরিয়ে যতদূর চোখ যায় গমের ক্ষেত। সেই বিরাট উপত্যকায় কত সুখী আত্মার যে ভিড়, ভাবতেই পারবি না। সে যেন সত্যিকারের স্বর্গ। তাঁরা আমাদের পথ দেখান। ভবিষ্যতের পথ বলে দেন। ফিসফিস করে কথা হয়। বার্চগাছের বনে শনশন করে হাওয়া বয়। হাওয়ার মধ্যে বয়ে আসে অজানা ফুলের সুগন্ধ। সেসব বহুকাল আগের কথা। কিন্তু আমার অনেক কিছু মনে আছে। যেটুকু ভুলে গেছি, আমি জানি, ওখানে গেলেই আবার মনে পড়বে। স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। তখন ঘুম ভেঙে গেলে বড় মনখারাপ হয় রে।”
আসিমভ আনমনে তাকায় একটা ছোট্ট ঝোপের দিকে। বেগুনি ফুল ফুটেছে ঝেঁপে। একটা হলদে পোকা খুব ব্যস্ত। পোকার গায়ে কালো ডোরা দাগ। ওই মেটে হলদে রঙের জন্য ও দিব্যি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে ঝোপের শিকড়বাকড় আর মাটির মধ্যে।
রু যে আসিমভের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটায়, গল্প করে, চুপচাপ বসে থাকে এটা বাকিয়েভের পছন্দ নয়। বাকিয়েভ অনেকবার আভাসে-ইঙ্গিতে বলেছে সে কথা। বাকিয়েভ থাকে নাতালিয়াদের বাড়ির একেবারে পাশেই।
“কী এত কথা বলো রু? ওই আসিমভ একটা ক্ষ্যাপাটে ছেলে। কোনও কাজ-কর্ম করে না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। নাতালিয়াকে দেখলে খুব কান্না পায় আমার। ওর সঙ্গে কথা বলা মানে সময় নষ্ট।”
“কিন্তু বাকিয়েভ, বাবা যে বলে আসিমভ অনেক জানে।”
“ছাই জানে। কী আবার জানে? কতগুলো ফুলপাতা গাছ আর পোকামাকড় চেনে।”
“না না বাকিয়েভ। ও অনেক অসুখ সারিয়ে দিতে পারে। ওই যে সেবার পুসিয়েস্কার হাতদুটো গোল হয়ে ফুলে উঠল, নাক দিয়ে জল ঝরছে আর অনবরত হাঁচি, আসিমভই তো বলল, একটা ফুলের রেণু থেকে ওর অমন হচ্ছে। বসন্তে পুসিয়েস্কা দুটো উপত্যকা পেরিয়ে যে জমিতে গাজর চাষ করে, সেই জমির পাশে ওই সোনালী-হলুদ ফুলের ঝোপ ভর্তি। পুসিয়েস্কা ওই ঝোপের ধারে বসে বিশ্রাম করে। ওই ফুলের রেণু লেগে ওর নাক দিয়ে জল পড়ছিল। হাত ফুলে যেত। বাড়ি এসে হাঁফাত খুব। আসিমভ কী তাড়াতাড়ি সারিয়ে দিল ওকে। তোমার মনে নেই?”
বাকিয়েভ বড় বড় চোখ করে তাকায়। রু আসিমভের জন্য এত যুক্তি সাজিয়ে রাখতে পারে, ওর ধারণা ছিল না।
আরে বাবা, রোগ সারাতে গেলে শুধু গাছপালা চিনলেই হবে? আর একদিন সারিয়েছে তো হয়েছেটা কি? রোজকার ব্যাপার হলে বোঝা যেত।
বাকিয়েভ কথা বাড়ায় না। তবে রু বোঝে, বাকিয়েভ তার সঙ্গে আসিমভের অসম বন্ধুত্বকে খুব ভালো চোখে দেখছে না। তারপর থেকে রু বাকিয়েভকে একটু এড়িয়েই চলে।
“যে ছেলেটা আসছে, সে তোর খুব বন্ধু হবে, দেখিস।”
আসিমভের হঠাৎ বলা কথায় হকচকিয়ে যায় রু।
“কার কথা বলছ আসিমভ? কে আসছে? কে আমার বন্ধু হবে?”
“তোদের বাড়িতেই আসছে। অনেক দূর থেকে আসছে সে। তারও ফর্সা গোলপানা মুখ। কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। ঘোড়ায় চড়বি তোরা। আর খুব খেলবি। ছুটে ছুটে খেলবি ওই কাপড়ের বল দিয়ে। ও বল খেলতে পারে। ওই বল খেলতে গিয়েই…” হঠাৎ চুপ করে যায় আসিমভ।
“বল খেলতে গিয়ে কী হয় আসিমভ? তুমি চুপ করে গেলে যে?”
“না না সে কিছু নয়,” সামলে নেয় আসিমভ। “কী যে কখন বলি আবোল তাবোল। ও তোদের বাড়িতে এলে নিয়ে আসিস আমার কাছে। গুহার মধ্যে আঁকা ছবির গল্প বলব তোদের।”
“কীসব তুমি বলছ আসিমভ? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কাকে নিয়ে আসব?”
আসিমভ যেন সম্বিত ফিরে পায়।
“না না। ওই যে তুই তখন বললি, তোদের বাড়িতে কারা থাকতে আসছেন…”
“সে তো বাবার সঙ্গে ওদের আসার কথা দু’তিনদিন পরে। কিন্তু তাদের তুমি চিনলে কেমন করে?”
রুয়ের চোখে কৌতূহল। সেই সরল দৃষ্টির প্রশ্নের সামনে মিথ্যে বলা যায় না।
“তাদের সবাইকে চিনি না। শুধু ওই ছোট্ট ছেলেটাকে দেখতে পেলাম এক ঝলক। আমার গার্জিয়ান স্পিরিট আমাকে সব বলে দেয় রু। সবসময় নয়, তবে কখনও কখনও আমি সব বুঝতে পারি। কেমন করে যেন সব দেখতে পাই। এসব কথা কাউকে বলিস না। কেউ বিশ্বাস করবে না। শহুরে মানুষ, সভ্য পৃথিবী এই জগতটার খবর জানে না। এ এক সীমানা পেরিয়ে যাওয়া অন্য জগত। এর ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। আমার নিজের বোন নাতালিয়া নিজেই আমার একটা কথাও পাত্তা দেয় না। কেবল বলে, তুই একটা আস্ত পাগল। ওই বাকিয়েভ রোজ ঠাট্টা-তামাশা করে আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি সত্যিই জানি, এই পৃথিবীর জীবিতরা ছাড়াও আর একটা জগত আছে, সেই জগতের খবর রাখতেন আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ। আমার সেই ফকির তেমন একজন। সেইজন্যেই ওঁর কাছে প্রায়ই ছুটে যাই, শুনি, ওর কাছে বসে আপ্রাণ বোঝার চেষ্টা করি। শিখতে পারিনা সব। ও তো সব শেখায় না। জানিস রু, ওই ফকির দেখিয়েছে, তার হাতে পাঁচটার জায়গায় ছ’টা আঙুল। এই দেখ রু, আমার পায়েও তাই।”
রু দেখে, আসিমভের ডান পায়ের কড়ে আঙুলের পাশে আর একটা পুঁচকে আঙুল। আরে! এতদিন লক্ষ্য করেনি কেন?
“ওটা কেন আছে আসিমভ?”
“ওটা বলতে পারিস একরকম চিহ্ন। ওইরকম কোনও চিহ্ন থাকে কারও কারও। সবার নয়। ওই ফকির আমাকে বলেছে। যাদের থাকে, হয়ত একটা বেশি দাঁত, বেশি আঙুল, চোখটা একটু ট্যারা… তারা অনেকের থেকে আলাদা। তারা ওই দুই জগতের যোগাযোগ। আর রু… তোকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, আমার কেমন মনে হচ্ছে জানিস, ওই যে ছেলেটিকে আসতে দেখছি তোদের বাড়ির দিকে, ও নিজেও আমার মতোই জুড়ে থাকে অন্য পৃথিবীর সঙ্গে। সেই জন্যেই ওর আসার শব্দ পাচ্ছি আমি। একটা তরঙ্গের মতো অনুভূতি; কেমন একটা আশ্চর্য টান…”
আসিমভ চুপ করে যায়। রু তাকিয়ে দেখে, সূর্য হেলে পড়েছে ডানদিকের পাহাড়ের কোলে। অনেক বেলা হল।
উপত্যকা বেয়ে ছুটে আসে একটা লাল টুকটুকে জামা। ইলানা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ওদের দিকেই আসছে। রু জানে, ইলানা ওকে খুঁজতে আসছে। ওকে ডেকে নিয়ে যাবে। এবার যে ঘরে ফিরতে হবে।


ভানু রীতিমতো উত্তেজিত। ওশ শহর থেকে গাড়িতেই এসেছে অনেকটা। তারপর ওদের ঘোড়ায় চড়তে হবে। জুরিনদের গ্রাম ঘোড়ায় প্রায় এক ঘন্টার পথ। এই ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ পেয়েই হইচই জুড়ে দিয়েছে ভানু। এই ঘোড়া সেই দার্জিলিঙের ম্যাল বা দীঘার সী-বিচের ঘোড়া নয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়ানো ঘোড়াগুলো পর্যন্ত এদের কাছে শিশু। যেমন এদের লম্বা-চওড়া চেহারা, তেমন তাদের তেজ। ভানুর ঘোড়ায় চড়ে বসল জুরিন আর ভানু দু’জনে মিলে। ভানু সামনে। তাকে শক্ত করে ধরে রইল জুরিন। অনেকটা চড়াই-উতরাই ভেঙে যাওয়া। বিকাশ আর ইরিন আলাদা ঘোড়ায়। প্রত্যেকের সঙ্গে একজন ঘোড়ার দেখভাল করা জোয়ান পুরুষ। তাদের হাতেই লাগাম। তারাই পথ দেখিয়ে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে।
চড়াই-উতরাই পথ। কোনও কোনও সময় পাশের গিরিখাতে চোখ পড়লে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। আবার সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলে এ এক অপুর্ব প্রকৃতি। আকাশ আর মাটির মাঝখানে ঢেউখেলানো সবুজ জমি। পাথর-কাঁকর রয়েছে, কখনও রং-জ্বলা ঘাস। ঝোপে বুনো ফুলের নানান রঙ। ভানু একা একাই কলকল করে কথা বলে। চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে এটা-সেটা। চারদিকের পাথরে পাহাড়ে তৃণভূমিতে ওর কচি গলার জিজ্ঞাসা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।
ভানুর বাবা বিকাশ চৌধুরীকে ডাক্তার ভেবে ভুল করেছিল জুরিন। বিকাশ একজন বিজ্ঞানী। আরও সঠিকভাবে বললে বিকাশ একজন গবেষক। তাঁর কাজকর্ম নিয়ে অবশ্য জুরিন কিছুই জানে না। শুধু জানে বিকাশ ইণ্ডিয়া থেকে এই দেশে এসেছেন তাঁর স্ত্রী ইরিনকে নিয়ে যেতে। ইরিন নিজেও একবছর ধরে এই দেশে গবেষণার কাজ করছেন। কাজের মেয়াদ শেষ। এবার তাই ওঁর দেশে ফেরার পালা। আর ফেরার আগে এই চমৎকার দেশটিকে তাঁরা তিনজনে মিলে উপভোগ করে যেতে চান। এই দেশের সংস্কৃতি, শিকড়, ঐতিহ্য… সব নিয়ে তাঁরা আরও বহুকিছু জানতে খুব আগ্রহী। আর ছোট্ট ভানু এত সুন্দর পাহাড় নদী আর উপত্যকার নির্জন সৌন্দর্য দেখে ছটফট করছে কেবল। সব দেখবে, সব গোগ্রাসে গিলে ফেলবে যেন।
“বাবা, আমরা স্টোন টাওয়ারের ওপর থেকে সেদিন এই ভ্যালিটা দেখেছি না?”
ভানুর প্রশ্নে হাসেন বিকাশ। সুলেইমান পাহাড়ে একটা ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে ওঁরা সকলে উঠেছিলেন গত পরশুদিন। ওল্ড টেস্টামেন্টের ইহুদি রাজা সলোমনের নামে এই পাহাড়। সেই পাহাড়ের একটি ছোট গুহায় আস্তানা বানিয়েছিলেন বাবর। তখন আত্মজীবনীতেও লিখেছেন এই শহরের কথা। ভানু সেইসব গল্প শুনে হাঁ হয়ে যায়। মুঘল সম্রাট বাবর যে এইরকম একটা গুহায় কখনও ছিলেন, ওর বিশ্বাসই হয় না। ওর ইতিহাস বইয়ের ছবি আর কাহিনির সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করে আপ্রাণ।
ওশ শহরটা চমৎকার দেখা যায় ওই পাহাড় থেকে। অনেকদূরে দেখা যায় ছোট বড় উপত্যকা। বিন্দুর মতো। জুরিন আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল ওইরকমই কোনও এক উপত্যকার চারণভূমির মধ্যে তাদের ছোট্ট গ্রাম। জুরিন বলে, ইউরোপ আর এশিয়ার মধ্যেকার সিল্ক রুটের ঠিক মাঝামাঝি বিন্দুতে এই পাহাড়।
“আপনারা এখানকার মিউজিয়মে যাবেন না?” একবার জিগ্যেস করেছিল জুরিন। ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ সমস্ত দ্রষ্টব্য নিখুঁতভাবে দেখিয়ে দেওয়া। জুরিন তার কর্তব্যে কোনও গাফিলতি করে না।
জুরিন দেখল, সুলেইমান পাহাড়ে ন্যাশনাল হিস্টোরিকাল অ্যাণ্ড আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়মের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইরিনের খুব ভাবসাব। সাধারণত সব ট্যুরিস্টরাই এই মিউজিয়ম ঘুরে দেখেন। ইরিন আর বিকাশ একেবারেই ভেতরে ঢুকতে চাইলেন না। তাঁদের আচরণে মনে হল, এখানে তাঁদের আর নতুন করে দেখার কিছু নেই। ভানু দারুণ ফূর্তিতে। তার ওইসব বন্ধ ঘরের মধ্যে ইঁট-কাঠ-পাথর মূর্তি ছবি একেবারেই ভালো লাগে না।
এখানে এসেই রুয়ের সঙ্গে দারুণ ভাব জমে গেছে ভানুর। রুয়ের জন্য অনেক চকলেট এনেছিল ভানু। প্রথম আলাপেই দু’হাত ভর্তি চকলেট রুয়ের দিকে এগিয়ে দেয় ভানু।
কথা বলে লাভ নেই। কেউ কারও ভাষা জানে না। কথা বলার দরকারও নেই। নিজেদের সংকেতময় ভাষা ওরা নিজেরাই চটপট তৈরি করে নিয়েছে।
“এই নাও।”
ভানুর চোখেমুখে হাসি উপচে পড়ছে। রু একটু লাজুক। সে প্রথমেই হাত বাড়ায় না। সে ঘাড় নাড়ে। না থাক বরং।
ভানু আরও একটু এগিয়ে যায় ওর দিকে। নিতেই হবে, ধরো বলছি। তোমার জন্য এনেছি না?
দু’তিনবারের জোরাজুরির পরে রু ধীরে ধীরে ওর হাতটা এগিয়ে দেয় নতুন বন্ধুর দিকে। ভানুর দিকে তাকিয়ে ততক্ষণে ওরও একগাল হাসি।
ভানু হেসে বলে, “ফ্রেণ্ড। ওকে?”
রু ঘাড় নাড়ে। “ইয়েস। ফ্রেণ্ড”।
ইরিন বিকাশ আর ভানুর থাকার জন্য তৈরি হয়েছে ঝলমলে এক তাঁবু। এখানকার ভাষায় ইয়ার্ট। কাঠের কাঠামোর ওপরে চামড়া আর পশমি কাপড়ের অপূর্ব আস্তরণ। তার ওপরে ঝলমলে সব লেস লাগানো। হাতে বোনা পশমের লেসের সূক্ষ্ম কারুকাজে চোখের আরাম হয়। চারপাশের খোলামেলা উজ্জ্বল নীল-সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে এখানকার বাসিন্দাদের এই নান্দনিক প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বিকাশ।
ইয়ার্টে ঢুকে অবাক হয়ে যান দুজনেই। কী সুন্দর করে সাজানো। ভানু একবার তাঁবুর মধ্যে ঢুকে ব্যাগ রেখেই আবার ছুটে বেরিয়ে গেছে বাইরে। এই এত বড় খোলা উপত্যকায় ছুটে বেড়ানোর অঢেল জায়গা দেখে ভানু আনন্দে দিশেহারা।
বিকাশ ঘুরে ঘুরে দেখেন তাঁবুর মধ্যে প্রতিটি কোণ। দেওয়ালে কাঠের প্যানেলে টাঙানো রয়েছে নানান ধরনের হাতের কাজ। ছোট ছোট রঙিন থলিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। এদের তাক বা ক্যাবিনেট তৈরির জায়গা নেই। তাঁবুর মধ্যে আলমারিজাতীয় ফার্নিচার রাখা সম্ভব নয়। ঝোলানো থলি দেখে বিকাশের মনে হল ছেলেবেলায় শ্রীরামপুরে মামাবাড়িতে দিদিমার দড়ি দিয়ে বানানো শিকার কথা। রান্নাঘরে শিকায় ঝোলানো থাকত কত জরুরি জিনিস। বেড়ালের উপদ্রব আর দস্যি ছেলেপুলের হাত থেকে বাঁচতে অনেক কিছুই শিকেয় তুলে রাখতেন দিদিমা।
বিকাশ দেখেন ইরিন ব্যাগ থেকে বের করে গুছিয়ে রাখছে তার নোটবুক আর যন্ত্রপাতি।
“ওগুলো তুমি সব বাইরেই রাখবে?”
“না না, একটু মিলিয়ে দেখে নিচ্ছি সব ঠিকঠাক এনেছি কিনা। কিছু ভুলে গেলে আবার সেই অতদূর ওশ অবধি যাওয়া। আর এখানে তো ফোন বা ইন্টারনেটের তেমন ভালো অবস্থা নয়। মোবাইলের নেটওয়ার্কই নেই।”
“ইরিন, তুমি ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছ তো?”
“বিকাশ, তুমি আমার ওপর ভরসা রাখো। এ আমার বহুদিনের গবেষণা। জিপিএস পজিশন, স্যাটেলাইট ইমেজ আর পুরনো যা কিছু কাজকর্ম সব দেখেই তো মিলিয়ে নিয়ে এসেছি। এত ভুল আমার হতেই পারে না।”
“কিন্তু দেখো, এখানকার মানুষজনের কাছে আমরা অতিথি। আমাদের কোনও আচরণে যদি এরা আমাদের সন্দেহ করেন…।“
“সেইজন্য তো ভানু আছে। ভানু যতক্ষণ ওদের মধ্যে থাকবে, ওরা কেউ বুঝতে পারবেন না, কেন আমরা এসেছি এইখানে”।
“খুব ভালো করে ভেবে বলো ইরিন, মাসখানেকের মধ্যে তোমার কাজ শেষ হবে? আমি আমার ইন্সটিট্যুটকে যতটা সময় লাগবে বলে চিঠি জমা দিয়েছি, তার মধ্যে…”
বিকাশকে কথা শেষ করতে দেন না ইরিন।
“মাসখানেক টানা সার্ভে করতে পারলে ধরে নেব, আমার কাজ সবে শুরু হল। পুরোটা আমার একার দায়িত্ব নয়। আমি শুধু যা কিছু জেনেছি, পড়েছি, সেটা নিশ্চিতভাবে হাতেকলমে মিলিয়ে দেখতে চাই। তারপর গাইড জানাবেন কী করতে হবে। শত হলেও এই দেশ আমার জন্মভূমি নয়। আমি এখনও একজন রিসার্চ স্কলার। এই দেশে এসে কাজ করার জন্য আমার নিজের দেশের ছাড়পত্র দরকার হয়েছে…”
“এই প্রোজেক্ট নিয়ে তুমি তোমার ইউনিভার্সিটির গাইডের সঙ্গে ভালো করে কথা বলেছ তো?”
ইরিন ব্যাগ থেকে সব বের করে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে, “আমার হোম ইউনিভার্সিটি, এখানকার সিনিয়র স্কলার, সবার সঙ্গে সব কথা বলে এসেছি বিকাশ। আজ এক বছর ধরে এই বিষয়গুলো ঘাঁটছি আমি। আমি ঠিক জানি, এই সেই জায়গা। জুরিনের মতো একজন গাইড আর জুরিনেরই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা পাওয়া স্রেফ কপাল বলতে পারো। এখানে জুরিনের নিজের বাড়ি না থাকলে আমার কাজ করা মুশকিল হত। সব গ্রাম এখনও হোম-স্টে’র ব্যবস্থা শুরু করেনি। যদি সফল হতে পারি… প্লিজ তুমি একটু সাহায্য কোরো। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।”


রুয়ের খুব মজা লাগছে ভানুকে দেখে। ওর পায়ে সামান্য একটু অসবিধে আছে। হাঁটার সময় একটা পা একটু টেনে হাঁটে। কিন্তু এখানে এসে অবধি এক মুহূর্ত স্থির নেই। কেবল ছুটে বেড়াচ্ছে। একবার ভেড়ার পালের মধ্যে গিয়ে তাদের মতো করে চারপায়ে হামাগুড়ি দিতে শুরু করল। নানী তো দেখে হেসেই কুটিপাটি। ভেড়াগুলোকে ওর ভারি পছন্দ হয়েছে। একবার কোলে নেয়, একবার চটকায়, তাদের নিয়ে জমিতে লুটোপুটি খায়, খিলখিল করে হাসে আর কীসব দুর্বোধ্য শব্দ বলে।
রু একটু দূরে বসে বসে চুপ করে ওকে লক্ষ্য করে।
ঘোড়ায় চড়ার খুব উৎসাহ ভানুর। সকাল থেকে অনেকবার ইশারা করেছে রুকে। ইংরেজিতে কথা বলতে বলতেই আঙুল দিয়ে আভাসে ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছিল ভানু।
“ক্যান ইউ রাইড?” দূরে চরে বেড়ানো ঘোড়ার দিকে ইশারা করে রু’কে জিগ্যেস করে ভানু।
“নো।”
ভানুর মুখ অন্ধকার। ওর বোধহয় মনে হয়েছিল রু ওকে ঘোড়ায় চরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে একপাক। আশা পূরণ না হওয়ায় গোমড়ামুখ। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! আবার ছুটেছে একটা ফড়িঙের মতো লম্বাটে পোকার পিছনে। এক মুহূর্ত স্থির থাকে না ছেলেটা।
রু অল্পসল্প ইংরেজি স্বচ্ছন্দে বলতে পারে। বুঝতেও পারে। ও ঠিক করল, ও ভানুর কাছে ইংরেজি শব্দ শিখবে, ভানুকে শিখিয়ে দেবে কিরগিজ ভাষা। আসিমভ পাশে থাকলে খুব ভালো হোত। অনেক তাড়াতাড়ি শিখিয়ে দিতে পারত সব। বাবাও পারে। কিন্তু বাবার অত সময় নেই। ভানুর বাবা-মায়ের কখন কী প্রয়োজন, কখন তাঁরা কোথায় যাবেন, এইসব খোঁজ-খবর রাখছে সর্বক্ষণ। একে অতিথি। তা’ও আবার ভিনদেশি অতিথি। এই প্রথম জুরিন তার হোম-স্টে শুরু করল। ঠিকঠাক চালাতে পারলে প্রতি বছর অন্তত চার-পাঁচটা পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে নিয়ে এসে এখানে রাখা সম্ভব। মা’কে কাল রাতেও বলছিল, এই আয়ের টাকা থেকেই রু’কে বড় কলেজে পড়তে পাঠাবে জুরিন। ছেলেটাকে যেন তার মতো আর এই গাইডের কাজ করে পেট চালাতে না হয়। রু অবশ্য গাইড হতেই চায়। বাবার থেকেও বড় গাইড।
কিন্তু রু জানে, বাবা এই প্রথম দিনেই ভানুকে নিয়ে আসিমভদের বাড়ি অবধি অতদূর যেতে দেবে না। আবার কাউকে কিছু না বলে চলে গেলে খুব বকবে। ওর একটু অস্বস্তিও হয়। ভানুর পায়ে একটু অসুবিধে আছে। ও যদি অতটা রাস্তা হেঁটে হেঁটে যেতে না পারে! ইলানাকে ডেকে জানিয়ে দিল রু, আজ আর নাতালিয়ার কাছে পড়তে যাবে না। বাড়িতে গেস্ট এসেছে। কয়েকদিন পরে যাবে। মনে মনে ভাবল, নাতালিয়াকে খবর দেবার সময় আসিমভ যেন জানতে পারে, রু কেন আসেনি। রুয়ের নিশ্চিত বিশ্বাস, খবর পেলে আসিমভ নিজেই চলে আসবে রুয়ের খোঁজ করতে। ভানুকেও দেখতে আসবে। কীসব বলছিল কাল ভানুর সম্বন্ধে। কীসব সম্পর্ক আর অন্য পৃথিবী। মাঝেমধ্যে এত হেঁয়ালি করে আসিমভ…।
ভানু একটা ঘোড়ার গায়ে হাত বোলাচ্ছে। গাঢ় খয়েরি রঙের ঐ ঘোড়াটা খুব খামখেয়ালি। একবার যদি হালকা করে একটা চাঁটা লাগায়…। ওরে বাবা। ওর একটা আলতো চাঁটি খেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! রু’ও দৌড় লাগাল ওর পেছনে। বাবার কড়া নির্দেশ, ভানুকে চোখের আড়াল করা চলবে না। রু আর ইলানাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভানুর পাশে পাশে থাকার। ইলানা আর কতক্ষণ থাকে। এই তো এখন গড়গড়িয়ে হাঁটা দিল নাতালিয়ার বাড়ির দিকে। অগত্যা রুয়ের একার দায়িত্ব।
“প্লিজ ভানুস্কা, নো, নো। নট ডু। কাম কাম। প্লিজ।”
রুয়ের হাঁই হাঁই করে ছুটে আসা দেখে ভারি মজা পেয়ে গেছে ভানু। বেশ বুঝেছে, ওকে ঘোড়ার কাছে যেতে বারণ করা হচ্ছে। সে হোক। তা’ বলে রুয়ের সঙ্গে ছুটোছুটি করে খেলতে তো বাধা নেই।
ছুটতে ছুটতেই ভানু চেঁচিয়ে ওঠে, “রু, ক্যাচ মী ইফ ইউ ক্যান।”
বোঝো কাণ্ড। এই ছেলে যে ছুটোছুটি করতে ওস্তাদ। কেবল পাঁই পাঁই করে এদিক-ওদিক পালায়। এখানে অনেকটা জায়গা সমতল হলেও বেশ কিছু অংশ উঁচুনিচু। একবার ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া। আবার উঠে আসা। ভানু কী এই রাস্তায় ছুটে অভ্যস্ত?
“ভানুস্কা, কাম। নো। প্লিজ।”
রুয়ের আকুল ডাক একবার ভানুর কানে গিয়ে পৌঁছয়। শুধু “নো” শুনছিল। “ভানুস্কা” ডাকটা ওর কাছে একেবারে আনকোরা নতুন। বাঃ, এটা দারুণ তো! ভানু থেকে ভানুস্কা।
ভানু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। রু ওর কাছে ছুটে আসছে। ও কাছে আসা অবধি অপেক্ষা করে।
“হোয়াট ডীড ইউ কল মী?”
ভানুর কথা বুঝতে পারে না রু। হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে শুধু।
“মী… মাই নেম। মাই নেম ইজ ভানু। ভা আ নু উ। ইউ কল্ড মী ভানুস্কা। নট ভানুস্কা, আই অ্যাম ভানু”, স্পষ্ট গোটা গোটা করে উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দেয় নিজের নাম।
“ইয়েস। ভানুস্কা। নেম ভানুস্কা। আই রু। ইউ ভানুস্কা।”
“নো নো, নট ভানুস্কা। ওনলি ভানু।”
দুই সমবয়সী নিজেদের নাম বোঝাতে ব্যস্ত। ভানু কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন রু ওকে ভানুস্কা বলে ডাকছে। বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে বোঝানোর পর হাল ছেড়ে দেয় ভানু।
“ওকে। ফাইন। উই আর ফ্রেণ্ডস।”
বন্ধুত্বের মধ্যে নাম খুব জরুরি নয়। দরকারি হল মনের মিল। একসঙ্গে খেলা, বেড়ানো, হই হই, আড্ডা। ভানুও ঠিক করে নিল, রুয়ের দেশের ভাষা চটপট শিখে নিতে হবে। তা’ না হলে আবার কীসের বন্ধু!
রুয়ের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ভানু বলে, “লেটস রান, রুস্কা, লেটস রান।”
রু নিজের নামবদল বুঝতে না বুঝতেই দেখে একটা খাড়াই অংশের পাশ দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে ভানু। ওই কিনারাটা খুব বিপজ্জনক। ওখান দিয়ে ছোটা মুশকিল। সাবধানে না গেলে ওখান থেকে গড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। গড়িয়ে পড়লে কতটা ব্যথা লাগবে সেটা নির্ভর করছে, সে কতটা জোরে আর সতর্ক হয়ে দৌড়চ্ছে তার ওপর। ভানুর এই উপত্যকার চরিত্র একেবারে অজানা। ওকে আটকাতে হবে ভেবে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে রু, “ভানুস্কা, কাম। ভানুস্কা নো।”
ফিরে আসার জন্য বা না যাওয়ার জন্য বারণ করার শব্দগুলো ভানুর কানে পৌঁছল না। অনেকটা বিস্তীর্ণ উপত্যকায় সমতল ফুরিয়ে যেখানে উঁচু-নিচু ঢাল, সেখানে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ভানু। দু’চারটে ছোট ঝোপের পাশ দিয়ে ওর শরীরটা গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে রু পাগলের মতো চেঁচিয়ে ডাকে “ভানুস্কাআ আ আ আ…”
উপত্যকার হাওয়ায় বয়ে যায় ওর কচি গলার স্বর।

ভানুর তেমন চোট লাগেনি। চোট লাগার কথাও নয়। খাড়াই বেয়ে বেশ খানিকটা নেমে গিয়েছিল কেবল। হাঁটু আর কনুইয়ের নুনছাল উঠে গেছে। সারা গায়ে শুকনো ঘাস আর শক্ত ঝোপের আঁচড়। কাটাকুটি দাগ আর একরাশ ধুলো। তার মধ্যেও একগাল হাসি। যেন কী এক বিরাট অভিযান শেষ করে ফিরল।
রু হাঁফাতে থাকে ওর পাশে বসে।
“ভানুস্কা, তুমি একটা বোকা। শুধু বোকা নয়। আস্ত খ্যাপা। ওইখানে অত জোরে কেউ দৌড়য়? আমরা কেউ কক্ষনও দৌড়ই না ওখানে। তুমি আরও জোরে পড়ে যেতে পারতে। বেকায়দায় উলটে পড়লে কী হতে পারত জানো? ঘাড়ে খুব লাগত। হাড় ভেঙে যেতে পারত। তোমার যে হাতপাগুলো সব আস্ত আর অক্ষত আছে, এই ঢের। ভাগ্যিস আশেপাশে বাবা বা বড়োরা কেউ নেই। থাকলে তুমি আজ টের পেতে। তুমিও বকুনি খেতে, আমাকেও খুব বকত সকলে। আর কক্ষনও অমন ছুট লাগাবে না, এই বলে দিলাম, কেমন?”
রু একটানা বলে যায়। ওর নিজের ভাষায়। ভানু চুপ করে তাকিয়ে থাকে রুয়ের মুখের দিকে। একটু লাজুক মুখে শুনছে। অপরাধীর মতো হাসি লেগে আছে ওর চোখেমুখে। এইভাবে পড়ে যাবে, ও নিজেও ভাবতে পারেনি। আরও একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। ভানুর পায়ে জন্মগত যে ত্রুটি আছে, তা নিয়ে ওকে স্কুলে অনেকেই খ্যাপায়, পাড়ার পার্কে টিটকিরি দেয়, অবজ্ঞা করে, রু তো সেসব জানে না। তবু রুয়ের কথাগুলোর দিকে কান পেতে ছিল ভানু। ভাষার মধ্যে অনেক অচেনা শব্দ থাকতে পারে, কিন্তু বন্ধুর জন্য উদ্বেগ প্রকাশের কোনও বিশেষ অক্ষর আর বর্ণমালা শিখতে হয় না। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেই বোঝা যায়। ভানু ওর দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে রুয়ের দুটো হাত। ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “রু, আমার একটুও ব্যথা লাগেনি, বিশ্বাস করো। প্রথমে একটু ভয় করছিল, তারপর মনে হল, বেশ একটা স্লাইডে চড়ছি… সাঁ করে নেমে যাব গড়িয়ে। যেই অমন ভাবলাম, আর ব্যথার কথা মনেই রইল না। কিন্তু, আমি আর কক্ষনও এমন করব না। দেখে নিও। এবার থেকে তোমার হাত ধরে ছুটব, কেমন?”
ভানু শুধু বলতে পারে না গড়িয়ে নামার সময় ওর এক একবার মনে হচ্ছিল, কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী যেন নড়ে উঠছে ওর পিঠের তলায়। সে যেন আরামে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ এইসব নড়াচড়া গড়াগড়িতে খুব বিরক্ত। এক্ষুনি সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে। রু’কে এই ভাবনাটার কথা তাকে বলতে হবে। কিন্তু কোন ভাষায় বলবে? আর বললেও কী রু বুঝতে পারবে ভানুর কথা? যদি হেসে উড়িয়ে দেয় ওর কথা? তাহলে ওর খুব কষ্ট হবে। খুব। বন্ধু যখন বন্ধুর মনের কথা বোঝে না, তখন গলার কাছটা কেমন টনটন করে ওঠে।
দুই দূরদেশি বন্ধু হাত ধরে চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। সূর্য তার তেজ দিয়ে ধুয়ে দেয় ফারঘানা উপত্যকা। দূরে পাহাড়ের স্থির রেখায় শব্দ থমকে থাকে। সবুজ আর নীলের সবরকম শেডের রঙের প্যালেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারদিকে। তারা সকলে আজ রু আর ভানুর বন্ধুত্বের সাক্ষী।


স্মিথসনিয়ান ইউনিভার্সিটির ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়মে একটা ছবি রয়েছে। পাসেল্কের আঁকা। তাতে প্রি-ক্যামব্রিয়ন যুগের সব বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। খনিজ পদার্থ মিশে রয়েছে ফুটন্ত জলে। স্ট্রোমাটোলাইট ভাসছে সেই ফুটন্ত জলপ্রবাহের মধ্যে। প্রায় চার হাজার পাঁচশো সত্তর লক্ষ বছর আগে, সেই প্রাক-ক্যামব্রিয়ন যুগে পৃথিবী তখনও গলে নরম হয়ে থাকা একটা বলের মতো ঘুরে চলেছে। চারপাশে আগুনের তাপ। সেই আঁচে ফুটছে চারপাশ। সৌরজগৎ তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষ তো দূরস্থান, তখন প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।
প্রাক-ক্যামব্রিয়ন একটা দীর্ঘ সময়। প্রায় চারশো ষাট কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম আর বাহান্ন কোটি বছর আগে প্রথম আসে বহুকোষী প্রাণী। পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাসের আটভাগের মধ্যে সাতভাগই জুড়ে রয়েছে এই প্রাক-ক্যামব্রিয়ন যুগ।
সময় কত বদলে দেয় চারপাশ। প্রকৃতি তার নিজের ছন্দে চলে। খামখেয়ালিপনা সে একেবারে বরদাস্ত করে না। তার সব কিছুই নিয়মমাফিক। তা’ না হলে এই পৃথিবীর বুকে প্রাণ সৃষ্টি হত না। সেই প্রাণ টিঁকে থাকত না এত লক্ষ লক্ষ বছর। ভীষণ ধীরে ধীরে বদল হয়েছে চারপাশের পৃথিবীর। কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। যখন যে মানিয়ে নিতে পারেনি, সে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া… মানুষ কবে শিখবে?
ইরিন দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা ছোট্ট টুল নিয়ে ইয়ার্টের বাইরে চুপ করে বসেছিল। ভাবছিল পাসেল্কের আঁকা সেই ছবিটা। গরম লাভার স্রোত বয়ে যাচ্ছে নদীর মতো। এখানে বাইরেও খুব রোদ। তবে গরম নয় ততটা। ইরিন সাধারণত লাঞ্চের পর একলা বসে সামান্য গুছিয়ে নেয় নিজের এলোমেলো চিন্তাগুলোকে। ওর বরাবরের অভ্যেস। ইয়ার্ট তাঁবুগুলোর মাথাটা এক্কেবারে গোল, ওই চূড়াটিকে ওদের ভাষায় বলে শানিরাক। প্রতিটি তাঁবু একেবারে একই মাপের, আর ওই শানিরাক অংশটি ভারি নিপুণ দক্ষ হাতে তৈরি। একদম প্রকৃতির মতোই। কোথাও যেন বাড়তি কিছু নেই। নিটোল আর নিখুঁত। পাহাড়, উঁচু-নিচু মালভূমি, সমতল অঞ্চল, নদী, নদীর বাঁক, ঝোপঝাড়, ঘাসফুল, পাখি, পোকামাকড়, প্রজাপতি- সব মাপসই। ঠিক যেন সেখানেই সেটি থাকার কথা ছিল। অথচ মানুষ তার শক্তির দম্ভ নিয়ে যখনই প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দ পালটে দিতে যায়, তখনই ঘটে বিপর্যয়। মানুষ আর কবে এই সহজ সত্য বুঝবে? সে বুদ্ধি আর প্রযুক্তির জোরে সবকিছু জয় করতে চায়, কিন্তু ধরিত্রী স্নেহময়ী মায়ের মতো শুধু শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চারপাশে সবকিছু আগলে রাখতে চায়। গায়ের জোরে অধিকার আর ভালোবেসে আঁকড়ে ধরার মধ্যে যে ফারাকটুকু রয়েছে, এত বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও মানুষ তা বুঝতেই পারে না।
ভানুর হাত-পা ছড়েছে খানিক। দুপুরে খেতে বসার সময় দেখা গেল। নুনছাল উঠে গেছে কনুই, হাঁটু, কবজিতে। ভানু তেমন সাড়াশব্দ করেনি। ওর খুব সহ্যশক্তি। কিন্তু বিকাশ ভয় পাচ্ছিলেন। এত ছুটোছুটি করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে খুব মুশকিল। এখান থেকে শহর ঢের দূরে। যদিও ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা তাঁদের কাছে মজুত। ছোটোখাটো যে কোনও বিপর্যয় তিনি নিজেই সামলে দিতে পারবেন। তবুও, খামোখা দুশ্চিন্তা বাড়ানোর কোনও মানে হয় না।
“কেমন করে হল, ভানু?” শান্ত গলাতেই জিগ্যেস করলেন বিকাশ।
“ওই যে, ধুপ করে পড়ে গেলাম।” ভানু এইসব সময়ে আরও শান্ত গলায় কথা বলে। যেন কোথাও কিছু ঘটেইনি।
“না না, তুমি যে পড়ে গিয়েছিলে, সে তো তোমাকে দেখেই দিব্যি বুঝতে পারছি। বসে বসে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো কারও কখনও হাতপা ছড়ে যায় না। আমার প্রশ্ন হল, হঠাৎ তুমি ধুপ করে পড়ে গেলে কেমন করে?”
ভানু খুব গম্ভীর হয়ে যায়। ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে করতে বলে, “উমম, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ওই জাস্ট একটু গড়িয়ে গেলাম। মজা লাগছিল জানো! মনে হচ্ছিল পার্কের স্লাইডে চড়ছি। স্লাইড থেকে নামলেও কিন্তু হাত-পা ছড়ে যায়। আমাদের বাড়ির পিছনের চিলড্রেন পার্কটা মনে নেই তোমার? কেমন এবড়ো-খেবড়ো সিমেন্টে বাঁধানো ছিল? খুব লাগত। আজ কিন্তু আমার ততটা লাগেনি। ওখানে ঘাস-টাস ভর্তি ছিল। অনেক ঝোপ।”
ভানু মুখের মধ্যে রুটি ভর্তি করে চিবোতে চিবোতেই কথা বলছে দেখে ইরিন এবার বারণ করলেন।
“খেতে খেতে কথা বলে না ভানু। খাবার ফুড পাইপের মধ্যে না ঢুকে উইণ্ড পাইপের মধ্যে চলে যাবে। তখন বিষম লাগবে, কাশি হবে। কতদিন বুঝিয়ে বলেছি না?”
ভানু মুখভর্তি খাবার চিবোতে চিবোতে বাবার দিকে তাকাল। ইশারায় মা’কে বোঝাত চাইল, আমি কী একা কথা বলছি নাকি? বাবা নিজেই প্রশ্ন করছে। উত্তর দেব না?
বিকাশ একবার দু’জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভানু, তুমি জানো, মা এখানে একটা ভীষণ জরুরি কাজ করতে এসেছে। আমি মা’কে হেল্প করছি। তুমি এমন কিছু কোরো না, যাতে আমাদের কাজ পণ্ড হয়। একটু শান্তশিষ্ট হয়ে থেকো। কেমন?”
“আমিও হেল্প করতে পারি। আমাকে বোলো কী করতে হবে। আমি করব, আমার বন্ধু রু আছে। সে’ও করবে।” বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে ভানু, “জানো, আজ রু আমাকে কী বলে ডাকল? রু বলল, ভানুস্কা! আমি ওকে বলতে গেলাম, নট ভানুস্কা। ওনলি ভানু। তবুও ভানুস্কা বলেই ডাকছিল।”
বিকাশ আর ইরিন হাসেন। ইশারা করেন, খাওয়ার সময় আর কথা নয়।
লাঞ্চ আজ সাজিয়ে দিয়েছে জুরিন আর মারিয়া। ওদের এই দেশের শিরদাক কম্বলের ওপর ফুলছাপ ওয়াড় পরিয়ে মারিয়া সব ভাঁজ করে দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় কীভাবে রাখতে হবে… ওরা অগোছালো আর অপরিচ্ছন্ন থাকতে একদম পছন্দ করে না। লাঞ্চে সাজানো ছিল রুটি, অ্যাপ্রিকট আর র‍্যাস্পবেরির জ্যাম। জ্যাম নিশ্চই শহর থেকে আনা। তার সঙ্গে ঘোড়ার মাংস।
অনেক ভোরে ওঠে গ্রামের সকলে। বাড়ির বুড়োমানুষদের যত্নআত্তি করে, নিজেরা ফিটফাট হয়, ঘরদোর সাফ করে। তারপর ক্ষেতের কাজ, খামারবাড়ির পশুদের দেখভাল করা, চরতে নিয়ে যাওয়া। ওদের বিশ্রাম নেই। অথচ সারাদিন হাসিমুখ। বিকাশ আর ভানু লাঞ্চের পরে ঘরের মধ্যে বসে কীসব খুটখাট করছে। ইরিন হাতের ট্যাব খুলে আরও একবার দেখতে থাকলেন। গ্যালারিতে ছবি আর তথ্য ঠাসা। মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে দেখে ঝালিয়ে নেন।
সরোপড, স্টেগোসর আর অরনিথোপড। এরা সেই জুরাসিক যুগের তৃণভোজী ডাইনোসর। এরা ছাড়াও আরও অনেকে ছিল। যেমন কার্নিভোর বা মাংসাশীরাও ছিল প্রচুর। উত্তর আমেরিকার পশ্চিম প্রান্ত, ইউরোপের কিছু অংশ, পূর্ব আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে ডাইনোসরদের রাজত্ব ছিল, সেইটুকু নিয়েই বিশেষজ্ঞদের গবেষণা। কিন্তু এই কিরঘিজস্থানের ফারঘানা উপত্যকায় তেমন করে গবেষণা হয়নি। অথচ সোভিয়েতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজত্ব ছিল ডাইনোসরদের। দেখা গেছে, উনিশশো ছেষট্টি সালে ভার্জিলিন সাহেব এখানে খুঁজে পেয়েছিলেন শুধু সরোপডের কঙ্কালের সামান্য অংশ। ফারঘানা উপত্যকার তাশকুমির শহরের পশ্চিমে তখন রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভিড়। সেই শুরু। তারপর বিচ্ছিন্নভাবে খোঁজ চলেছে। মাঝেমধ্যে কিরঘিজস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য গবেষণার কাজ বন্ধ থেকেছে। আবার কিছুদিন পরে শুরু হয়েছে পূর্ণ উদ্যমে। তাশকুমির শহর থেকে দক্ষিণে আর দক্ষিণ-পূর্বে অনেকটা অংশে এখনও পাওয়া যেতে পারে তাদের অস্তিত্ব। লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বেশ কয়েকবার এসে কাজ করেছেন। কিন্তু নারিন নদীর উপত্যকায়, সরোপডের দু’একটা দাঁত আর পায়ের আঙুল ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। অথচ, ইরিন নিশ্চিত, এখানেই পাওয়া যাবে ডাইনোসরের ফসিল। তেমন করে খোঁজ করা হয়নি।
কোনও এক সেই আদিম যুগে ছিল প্রাচীন মহাদেশ প্যানজিয়া। তখন ট্রায়াসিক যুগের শেষ আর জুরাসিক যুগের শুরু। সারা পৃথিবী জুড়েই সেইসময় এই বিশাল প্রাণীদের অবাধ গতিবিধি। এশিয়া তখনও এশিয়া হয়ে ওঠেনি। তবু এই অঞ্চলটিকেই পরবর্তীকালে বলা হয়েছে ডাইনোসরদের সেন্ট্রাল হাব। তাদের জন্য তো পাসপোর্ট-ভিসা বা কাঁটাতারের কড়াকড়ি দরকার হয় না। অবশ্য সমতলভূমি বা স্থলভাগের কোনও সীমানাই ছিল না। আর মানুষের মতো বিভাজনপ্রিয় প্রাণীও আসেনি তখন। সমস্ত পৃথিবীতে তখন দুই ধরনের ডাইনোসর রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। একদল সিলোফাইসিড জাতীয়। তারা মাংস খায়। আর অন্য দলে আদি সরোপডোমর্ফ। এরা শাকাহারী। নন-ভেজ খাবারে এদের একেবারেই উৎসাহ নেই। শুরু দিকের সেই সরোপডদের দাঁত ছিল না। সরাসরি খাবার গিলে ফেলত তারা। কিন্তু প্যানজিয়া মহাদেশ ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল। মাটির অনেক গভীরে টেকটোনিক প্লেট নড়েচড়ে সরে গেল একে অন্যের কাছ থেকে। টুকরো হয়ে দূরে দূরে সরে গেল কিছু স্থলভাগ। ডাইনোসরেরাও বিবর্তিত হল। তারা মানিয়ে নিতে লাগল এক-একরকম স্থলভাগে। এক-একদিকে তাদের এক-একরকম প্রজাতির দাপট। তখন সমুদ্র আর পাহাড় গড়ে দিচ্ছে মহাদেশের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক গঠন। সব বিলুপ্ত হলে ক্ষমতাশালী বুদ্ধিমান লোভী মানুষ এসে নিজেদের সুবিধেমতো প্রকৃতিকে কুক্ষিগত করে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অথচ মানুষ কেন ভুলে যায় মহা শক্তিধর ডাইনোসর এই পৃথিবীর বুকে রাজত্ব চালিয়েছে টানা ষোলো কোটি বছর। নিশ্চিহ্ন বা বিলুপ্ত হতে তাদের কতটুকু সময় লেগেছে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ইরিন।
সভ্য মানুষ যদি বিবর্তনের ইতিহাসটুকুই শুধু মন দিয়ে পড়ত!
বহুদিন ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণির হাড় নিয়ে গবেষণা করছে আর্জেন্টিনার দ্য জাপালা মিউজিয়াম, মিউজিও দে লা প্লাটা, মিউজিও এজিদিও ফেরুগলিও ও রাও নেগ্রো এবং জারাগোজা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি জায়গা থেকে জার্নাল এনে খুঁটিয়ে পড়ছেন ইরিন। ক্রেটিসিয়াস রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হওয়া এক প্রতিবেদনে ইরিন পড়েছেন, এই হাড়গুলোর মধ্যে ডাইনোসরের পেলভিক স্ট্রাকচার বা কোমরের গড়ন আর লেজের মোট চব্বিশটি অংশের কশেরুকা পাওয়া গেছে। ওই ডাইনোসর টিরানোসরাস প্রজাতির। এরাই সরোপড হিসেবে পরিচিত। সে সময় পৃথিবীতে যেসব প্রাণী ছিল, তারমধ্যে সরোপড অন্যতম।
ইরিন সরোপড স্টেগোসর আর অর্নিথোপডের কঙ্কালের সমস্ত হাড়গোড় খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। সামনের ওই বিস্তীর্ণ উপত্যকাতেই হয়ত চরে বেড়াত তারা। নিরুপদ্রব, নির্ঝঞ্ঝাট। বিশাল লম্বা গলা, তেমনই বিরাট লেজ। চারটে স্তম্ভের মতো পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো অতিকায় শরীর। অতবড় দেহের তুলনায় খুবই ছোট একটা মাথা। পিছনের দুটি পায়ে পাঁচটি আঙুল। আর তার মাঝের তিনটিতেই রয়েছে নখ। সামনের পা দুটিতে বুড়ো আঙুলে নখ রয়েছে। সমস্ত পৃথিবীতে আজ অবধি যত প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছে, ডাঙায় বাস করা সেই প্রাণীর মধ্যে সবথেকে বিশাল আকৃতির এই সরোপড। নিতান্ত বেঁটে একটি সরোপডই উচ্চতায় প্রায় কুড়ি ফুট।
ভানুর সঙ্গে বসে জুরাসিক পার্ক ছবিটা অনেকবার দেখেছেন ইরিন। ওই ছবিতে যে সব জনপ্রিয় ডাইনোসর ছিল, তারা সবাই সরোপড প্রজাতির। এদের মধ্যে ছিল ডিপ্লোডোকস, অ্যাপাটোসরাস, ব্রঙ্কিওসরাস এবং ব্রন্টোসরাস। এই ডাইনোসররা সবাই জুরাসিক যুগে পৃথিবীতে মিলেমিশে বাস করত। কিন্তু ক্রেটিসিয়াস যুগের শেষের দিকে টিরানোসরাসরা প্রাধান্য পেয়েছিল। এই টিরানোসরাস হলো সরোপডদের মধ্যে বৃহত্তম। বিলুপ্তির আগে অন্যান্য সব সরোপডকে এরা মেরে ফেলে। এটা একধরনের আন্তঃপ্রজাতি সংঘর্ষ। ডারউইন সাহেব পরে তাঁর ন্যাচরাল সিলেকশন থিওরিতে নিজেদের প্রজাতির মধ্যে সংগ্রামের স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন। টিরানোসরাসগুলো অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া আর সব মহাদেশেই পাওয়া গেছে।
ঘাসপাতা খেয়ে বেড়ানো নিরীহ অথচ দৈত্যাকার প্রাণীটির নিশ্চিন্ত চারণভূমিতেই এসে পৌঁছেছেন ইরিন। এখন তাঁর কাজ শুধু নিশ্চিত প্রমাণ সংগ্রহ করা।


আসিমভ অনেক সকালেই এসে হাজির হল। রু জানত, আসিমভ ঠিক আসবে। রু’কে না দেখে ও থাকতেই পারে না। তার ওপর আছে ভানু।
রু অনেক ভোরে ওঠে। ভেড়াগুলোকে খামার থেকে সামনের ঘাসজমিতে ছেড়ে আসে। ঘর পরিষ্কার করে। ওর যা যা কাজ, সব করে তবে নাতালিয়ার বাড়ির দিকে রওনা হয়। এই দু’দিন নাতালিয়ার কাছে যাচ্ছে না। আসিমভ নিজেই এসে পড়ল।
“আরে ক্ষুদে দোস্ত, আমাকে তুমি ভুলেই গেলে যে!”
“কী যে বলো… ভুলে যাব কেন? ইলানা বলেনি তোমাকে গতকাল? আমি এখন ভানুস্কার পাহারাদার।”
“ভানুস্কা? তোমার নতুন বন্ধু? বুঝেছি। নতুন বন্ধু পেয়ে এই পুরনো দোস্তকে ভুলে গেছ। এ তোমার ভারি অন্যায়! তা কোথায় তোমার নতুন বন্ধু?”
“ও বোধহয় ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও। একটু পরেই বেরিয়ে এসে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে বেড়াবে দেখো। বাপরে! তুমি ভাবতে পারবে না ও কী দুষ্টু!”
সমবয়সী সঙ্গীকে ‘দুষ্টু’ বলার ভঙ্গিতে হা হা করে হেসে ফেলে আসিমভ।
জুরিন ক্ষেতের কাজে বেরোবেন বলে একেবারে রেডি। আজ বিকাশ আর ইরিন সঙ্গে যাবেন। বিকাশ থাকবেন জুরিনের সঙ্গে। চাষবাসের পদ্ধতি দেখবেন, সাহায্য করবেন। ইরিন বলেছেন, পুরো উপত্যকায় তিনি একাই ঘুরবেন, বিশেষ করে পাহাড়ের কোলের দিকটায়। ওইদিকে সাধারণত ঘাসজমি কম বলে ভেড়া গরু নিয়ে চরাতে যায় না কেউ। ওখানে ঘোড়ায় গেলেই ভালো হয়। ইরিন ঘোড়া নিতে চান সারাদিনের জন্য। ওখানেই থাকবেন সারাদিন। ওনার নাকি অনেক ছবি তুলতে হবে, পাথর কুড়োতে হবে। ব্যাগে করে সারাদিনের জন্য শুকনো খাবার, চা আর জল নিয়ে যাবেন।
বাকিয়েভ তার ঘোড়া নিয়ে আসবে একটু পরেই।
ততক্ষণে মারিয়া ওদের সকলের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। তার ফাঁকেই দেখে গেলেন আসিমভ এসেছে।
“এসো আসিমভ, একসঙ্গে সবাই চা খাব। আজ সকালের খাবারও খেয়ে যাও আমাদের সঙ্গে বসে।”
“চলো রু। কালকের একটা স্বপ্নের কথা বলব তোমায়। অদ্ভূত স্বপ্ন। আগে চা খেয়ে নিই।”
জুরিনের কাঠের বাড়ির বাইরের ঘরে সবাই মিলে গোল করে বসা হল। টুকটাক কথাবার্তা চলছে। এমন সময় একটা রিনরিনে গলা ডেকে উঠল, “রুস্কা, ফ্রেণ্ড! হে রুস্কা!”
রু প্রথমে থমকে গেল, তারপর ছটফটিয়ে লাফিয়ে উঠল।
“হে ভানুস্কা! কাম কাম। ভানুস্কা…” রুয়ের ডাকে লাফাতে লাফাতে ছুটে এল ভানু। আর ছুটে এসেই দু’হাত বাড়িয়ে দিল রুয়ের দিকে। রুয়ের ঠিক পিছনে একটা অন্য লোক। রু’কে জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে থাকে ভানু। লোকটাকে সে আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু বিদেশি ছবিতে এমন লালচে চুলের টকটকে ফর্সা লম্বা আর ধারালো মুখের চরিত্ররা ঘোরাফেরা করে। তাদের সঙ্গে ওর ভারি মিল। ভানুর মনে হয়, এই লোকটা আসলে একজন আরিয়ান, একজন আর্য। সেই আর্যসভ্যতার সময়কার কোনও মানুষ। যারা পাহাড় পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিল এককালে।
আসিমভ একদৃষ্টে তাকায় ভানুর দিকে। এই তো তার অনেকদিনের চেনা মানুষ। ইয়েনিসেই উপত্যকায় ওর মতোই এক বন্ধু ছিল তার। অনেকটা ওরই মতো। নিজেকে সামলে নেয় আসিমভ। এইসব কথা যে কেউ শুনলে ওকে পাগল বলবে।
হাত বাড়িয়ে দেয় আসিমভ। “ওয়েলকাম ফ্রেণ্ড। গুড মর্নিং”।
ভানু একগাল হেসে বলে, “ডু ইউ নো ইংলিশ?”
“ইয়েস মাই ফ্রেণ্ড। আ লিটল বিট। হ্যাভ ইউ টেকেন ইয়োর ব্রেকফাস্ট?”
“ইয়েস। হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?”
“মাই নেম? আই অ্যাম আসিমভ। অ্যাণ্ড আই নো, ইউ আর ভানু।”
ভানু অবাক হয়ে তাকায়। “হাউ ডু ইউ নো মাই নেম!”
আসিমভ মুখ ফুটে বলতে পারে না বড্ড বেশি আপন লাগছে তার ভানুকে। সে যেন শুধু এই দেশের নয়, এই সময়ের নয়, আরও অন্য কোনও দুনিয়ার অতি পরিচিত সঙ্গী ছিল এককালে।
ওদের কথাবার্তার মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসেন ইরিন।
“আমি এগোলাম ভানু। তুমি সাবধানে থেকো। বেশি হুটোপাটি কোরো না কিন্তু।”
“তুমি কতদূরে যাচ্ছ মা?”
“আমি… আমি ওই পাহাড়টার কোলের কাছে সারাদিন থাকব রে।”
“ও আচ্ছা। তুমি সাবধানে যেও। আই উইল বী ফাইন। রু ইজ দেয়ার,” হঠাৎ মনে পড়ে ভানুর, আসিমভকে দেখিয়ে বলে, “মা, মীট মাই নিউ ফ্রেণ্ড, হি ইজ আসিমভ।”
ইরিন হাত বাড়িয়ে দেন। হ্যান্ডশেক করা এই দেশের অত্যন্ত জরুরি সৌজন্যবোধ।
আসিমভ হাসিমুখে হাত মেলায়।
ইরিন এগিয়ে যান। ইরিন সারাদিন ওই পাহাড়ের কোলে কী এমন কাজ করবেন? শুধু ছবি তুলবেন? তা’ও আবার একা একা? আসিমভের ভুরু কুঁচকে থাকে।
বাকিয়েভ আজ তার ঘোড়ায় করে নিয়ে যাচ্ছে ইরিনকে। ঘোড়ায় চড়েনি কেউই। ঘোড়ার পিঠে ইরিনের বড় ব্যাগ। দুজনেই হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যায়। ইরিন কিরগিজ ভাষায় মোটামুটি স্বচ্ছন্দ। তিনি বুঝিয়ে বলতে বলতে যান বাকিয়েভকে, “সারাদিন ওখানে থাকতে হবে বাকিয়েভ। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে আমাদের। আমি জায়গাটা একটু ঘুরেফিরে দেখব। তোমার অসুবিধে নেই তো?”
বাকিয়েভের উত্তর শোনা যায় না। বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে ওরা।
“চলো আসিমভ। কী একটা গল্প বলবে বলছিলে…” রু এবার অধৈর্য।
“চল, আমরা ওইদিকের ঢালু পাথরটার কাছে গিয়ে বসি, ওখানে ছায়া পড়ে। তোদের আজ একটা স্বপ্নের গল্প বলব।…
অসমতল জমিতে গাছের ছায়া নেই তেমন। রুক্ষ্ম মাটি, বুনো কাঁটাঝোপই বেশি।
আসিমভ খুঁজেপেতে বের করে নিরিবিলি ছায়া। ভানুর ফর্সা গাল রোদের আঁচে টকটকে রঙ ধরেছে।
“এখানকার মাটি নোনতা। নদীও অন্তর্বাহী। কোনও নদী সাগরে গিয়ে মেশে না। সমুদ্রই নেই, গিয়ে মিশবে কোথায়? পাহাড়গুলো জন্মাল, এঁকেবেঁকে বেড়ে উঠল একটু একটু করে। যত তারা আড়ে-বহরে বাড়ছে, তত একটু একটু করে বৃষ্টি কমছে। পূর্বদিক থেকে বৃষ্টির হাওয়া আর এসে পৌঁছচ্ছে না এই দেশে। শুকিয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ক্রমশ মরুশহরের মতো শুকনো হয়ে গেল আমাদের দেশ।
কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। অনেক আগে, যখন ওই পাহাড়গুলো তৈরি হচ্ছে একটু একটু করে, সেই সময় পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। পাখিও নেই তখন। আকাশের কাছাকাছি লম্বা সব জানোয়ার চরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। জলে মাছেরা নেই। বুকে হাঁটা প্রাণীদের ভিড়। তাদের মধ্যে দুপেয়ে আর চারপেয়ে জন্তুরা কেউ খায় ঘাসপাতা, কেউ খায় মাংস। ঢিমে মেজাজে আপনমনে চরে বেড়ায়। কোনও তাড়া নেই, কোনও ব্যস্ততা নেই।
পৃথিবীটা আবার হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করল। অনেক বরফ, অনেক তুষারপাত। ঝরা পাতার মতো তুষার পড়ছে আকাশ থেকে। প্রচণ্ড কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। ধারালো হাওয়া শরীর কেটে বসে। চামড়া ফেটে যেতে চায়। কিন্তু তার আগেই শুরু হয়ে গেছে মারাত্মক হানাহানি। আঁচড়ে কামড়ে একে অন্যকে রক্তাক্ত করছে ওই অত বড় প্রাণীগুলো। প্রত্যেকের ভাগের খাবার কমছে, নিজেরা নিজেদের সঙ্গে লড়াই করছে খাবারের জন্য। আর সেইসঙ্গে তারা সংখ্যায় কমছে। গরম আবহাওয়ায় যারা বহু বছর ধরে অভ্যস্ত, তারা কনকনে ঠাণ্ডার সঙ্গে আর লড়তে পারল না। নিজেদের সঙ্গে লড়াই, নিজেদের মতো অন্য জন্তুদের সঙ্গে লড়াই, আবার পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ। তিনরকম যুদ্ধ করতে করতে সকলে একে একে হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে… চাপা পড়ে গেল বরফের স্তূপের তলায়।”
আসিমভ আপনমনে বলতে বলতে চুপ করে গেল একসময়। ভানু বলে, “আই নো দিস ফ্যাক্টস। তুমি জুরাসিক পিরিয়ডের সেই রেপটাইলের কথা বলছ। ওরা সব নানান ধরনের ডাইনোসর। আমাকে মা ডিটেলে বলেছে, ডাইনোসর ছিল পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু ওরাও এক্সটিংক্ট হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। আই হ্যাভ সীন সো মেনি মুভিজ অ্যাবাউট ডাইনোসর।”
রু কারও কথাই শুনছিল না। আসিমভ স্বপ্নের কথা বলতে আসেনি। বললে, রু’কে একলা বলত। আসিমভ শুধু ভানুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। রু ইংরেজি তত ভালো জানে না। গল্পটা সে ভালো বোঝেনি।
“ডু ইউ নো, মাই মাদার ইজ ওয়ার্কিং অন ডাইনোসর?”
ভানুর প্রশ্নে চমকে তাকায় আসিমভ। তাহলে সেই বিশাল জন্তুদের খোঁজ করার জন্যই ইরিনের এই গ্রামে আসা? আর একা একা ঘুরতে চাওয়া ওই পাহাড়ের উপত্যকায়! কিন্তু ইরিন একা পারবেন কী করে? প্রথমত কঠিন কাজ, শারীরিক সক্ষমতা দরকার। আর দরকার ধৈর্য। এই বিরাট অঞ্চলে অত হাজার লক্ষ বছর আগে কে ছিল, কারা ছিল, কীভাবেই বা ছিল, এসব জানতে চাইলেই কি জেনে ফেলা যায়? গ্রামের লোকেরা সব কিছু অত সহজভাবে না’ও নিতে পারে। তাদের সামান্য আপত্তিতে ইরিনকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হবে। হলেই বা তারা হোম-স্টে’তে থাকা বিদেশি অতিথি।
আসিমভ ঠিক করে নেয়, ইরিনকে সাহায্য করবে।
রু চুপচাপ বসেছিল। আসিমভ ইংরেজিতে একটানা কথা বলে গেলে ওর অসুবিধে হয়। ভানু সব বুঝেছে, রু তেমন করে বোঝেনি কিছু। গল্পের মজা পায়নি।
রু’কে মনমরা দেখে আসিমভ ওর মাথার চুল ঘেঁটে দিল একবার। এটা ওর আদর করার ধরন। যেন বুঝিয়ে দেয়, এই তো আছি আমি তোর সঙ্গে। খামোখা ভাবিস কেন? রু একটু হাসে।
“চল রু, তুই আমি আর ভানুস্কা কাল থেকে ইরিনের সঙ্গে যাব। ওই পাহাড়ের উপত্যকার দিকে। আমাদের সঙ্গে শুধু দু’একটা কুড়ুল বা ছুরি জাতীয় জিনিস রাখতে হবে”।
রু লাফিয়ে ওঠে। “আরিব্বাস! দারুণ ব্যাপার। ওদিকটায় সেভাবে যাওয়া হয় না কখনও। অত দূর। বেশ হবে, সারাদিন ঘুরব। ওই পাহাড়ের গুহাগুলো অবধি যদি যাওয়া যায় তো আরও মজা। কিন্তু আসিমভ, ঘোড়া ছাড়া আমরা অতদূরে আসা-যাওয়া করতে পারব না। বাবাকে বলতে হবে। এই দায়িত্বটা কিন্তু তোমার। বাবাকে রাজি করাতে হবে, ঘোড়া জোগাড় করতে হবে…” রু উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকে।
ভানু এবার একটু চুপচাপ। অনর্গল কিরগিজ ভাষায় বলে চলা রুয়ের কথার মধ্যে ওর চেনা কোনও শব্দ নেই। তবু চুপ করে শোনে। এর মধ্যেই একটু একটু করে শিখে নেবে ওদের কথা। রু’কে ইংরেজি শেখাতেই হবে। আর ছাড়াছাড়ি নেই।
আসিমভ বলে, “ভানু, তোমার মায়ের সঙ্গে ওই দিকটায় কাল আমরাও যাব? তোমার আপত্তি নেই তো?”
ভানু আকাশে হাত তুলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে!
“ওরেন্নাঃ… যাব যাব যাবই।” ওর কচি রিনরিনে গলার স্বর ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর। যেখানে আকাশ এসে লুটোপুটি খায় মাটিতে, হয়ত সেই অবধিই।

(চলবে)