Categories
গল্পগ্রাম |

রু। চতুর্থ পর্ব

179 |
Share
| ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩
শ্যামলী আচার্য

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

(নবম অধ্যায়ের পরে)

১০
ইরিন এগিয়ে গেছেন অনেকটাই।
বেশ খানিকটা ঢাল গড়িয়ে গিয়ে আবার সমতল। কাঁটাঝোপ কোথাও কোথাও। ঘাস প্রায় নেই বললেই চলে। শুকনো মাটি। পায়ে পায়ে ধূলো ওড়ে। বেশ গরম। রোদে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ।

আসিমভ সঙ্গে আসতে চাওয়াতে খুব খুশিই হয়েছেন ইরিন।
অঞ্চলের একজন মানুষ সঙ্গে থাকলে জায়গার হাল-হকিকত বুঝতে বেশ সুবিধে হয়, বিশেষ করে আসিমভের সঙ্গে সন্ধেবেলা বসে বহুক্ষণ কথা বলে ইরিন নিশ্চিত তিনি সঠিক জায়গাতেই এসেছেন।
কিরগিজ প্রশাসন অবশ্য তাকে ট্যুরিস্ট বলেই জানে, তাঁর ইন্সটিট্যুটের রিসার্চ গাইডের পরামর্শে একাই ফসিল এক্সক্যাভেশনে আসার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
কিন্তু গতকাল সারাদিন ধরে উপত্যকায় ঘুরে মনে হয়েছ, একা এই কাজ করতে গেলে মাস তিনেক লেগে যাবে। নিজের অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিসহ একটা ক্যারাভান বা তাঁবু থাকলে এত চিন্তা করতে হত না।
তবে কিছু নমুনা আর ছবি পেলেই তাঁর আপাতত চলবে।
আসিমভ গতকালই বলেছে একটা শুকনো নদীখাতের কথা। ইরিনের অভিজ্ঞ চোখ ঝকঝক করে ওঠে। সেডিমেন্টারি রক বা পাললিক শিলায় জমে পাথর হয়ে থাকা জীবদেহ তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।
আজ সেইদিকেই রওনা হয়েছেন সকলে। ভানু আর রু’কে প্রথমে ইরিন সঙ্গে নিতে চাননি। ওরা ছোট। ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সারাদিন মাটি আর পাথর খুঁড়ে বেড়ানোর উৎসাহ থাকবে না হয়ত। তার ওপর যা গরম। কিন্তু আসিমভ ইরিনকে চটপট রাজি করিয়ে ফেলে।
“ওরা অনেক বেশি উৎসাহ তোমাকে সাহায্য করবে, তুমি মিলিয়ে নিও। অন্তত প্রথম দিনটা তো সঙ্গে যাক।”
আসিমভের কথায় কী ভেবে রাজি হয়ে যান ইরিন।

নানীর কানে পৌঁছয় কথাটা। বিদেশি মহিলা দেশে বেড়াতে এসে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনে প্রথমে কিছু বলেননি।
কিন্তু পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম দিক নিয়ে তাঁদের বহু কুসংস্কার। ওইদিকের জমিতে চাষ-আবাদ তেমন হয় না। মাটি রুক্ষ, শুধু পাথর বোঝাই। সেইসব পাথরগুলোও বেশ অন্যরকম।
অনেকে বলে প্রচুর অপদেবতা ঘুরে বেড়ায় ওইদিকে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় স্পষ্ট।
হাড়ের মধ্যে দিয়ে হাওয়া চলে গেলে যেমন বাঁশির মতো আওয়াজ হয়, সেইরকম এক অলৌকিক সুর ভেসে বেড়ায় ওই উপত্যকায়।
কেমন গা-ছমছম করে। মনে হয়, ওইদিকে না যাওয়াই ভালো।
ধর্মভীরু নানীকে বোঝায় আসিমভ।
“শুধু ছবি তোলা হবে। আর আমরা একটু ঘোরাঘুরি করব। ওখান থেকে নুড়ি পাথর কূড়িয়ে আনব। এত চিন্তার কী আছে? ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছি, তেমন অসুবিধে হলে ফিরে আসতে কতক্ষণ?”
“তোমাদের নিয়ে ভাবি না, ওই বাচ্চাদুটোকে সঙ্গে না নিলেই পারতে। ওই হাওয়াটাই খারাপ। আমরা কেউ যাই না ওধারে আসিমভ।”
“আমি আছি নানী। চিন্তা কোরো না। ওদের ভালো না লাগলেই ফিরে আসব। আর বিপদ বুঝলেও চলে আসব চটপট।”
নানী একটু গাঁইগুঁই করতে থাকেন।
“দেখো বাপু, যাচ্ছ যাও, ওখানকার পাথর-টাথর কিছু সঙ্গে করে এনো না বাপু। আমার নানীর বাবা ছিল খুব দুঃসাহসী। সে কুড়ুল কোদাল নিয়ে ওই নদীর ধারে চাষের জমি তৈরি করতে গেসল। একা একাই যেত। একদিন মস্ত বড়ো এক দাঁত বয়ে নিয়ে এল ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে। মাটি খুঁড়তে গিয়ে নাকি পেয়েছে। সে ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছিল সেই দাঁত। ক’দিন পর থেকেই তার ধুম জ্বর। জ্বরের মধ্যে সমানে ভুল বকে চলেছে। গাঁয়ের বুড়ো পুশকিনিয়াস্তা কতরকম জড়িবুটি দিয়ে জ্বর সারানোর পাঁচন বানিয়ে খেতে দিলে। কিন্তু সেই ভুল বকা আর কমে না। সারাদিন পাগলের মতো কথা বলে চলে, আর আঙুল দিয়ে ওই পাহাড়ের দিকে দেখায়। জ্বরও সারে না। শেষে পুশকিনিয়াস্তার কথায় ওই দাঁত আবার ফিরিয়ে রেখে আসা হয় ঐ উপত্যকায়। তবে তার জ্বর সারে, সে সুস্থ হয়। সুস্থ হয়ে আর কোনওদিন সে যায়নি ওদিকপানে। কোন অপদেবতা রেগে উঠেছিলেন, তা’ কি আমরা জানি? শুধু আমাদের সকলকে পইপই করে বলে দেওয়া আছে, ওদিকে আর যাবার দরকার নেই। আজ তোমরা ওইদিকে যাচ্ছ যাও, কিন্তু দয়া করে কিছু নিয়ে এসো না। ওখানে যা আছে, ওখানেই থাকতে দাও।”
আসিমভ নানীকে আশ্বস্ত করে, এমন কিচ্ছু ঘটবে না। বিদেহী আত্মারা সেই কোনকাল থেকে সুরক্ষিত রেখেছেন এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটিকে, তাঁরা কোনও অনিষ্ট করতেই পারেন না।
বাকি ছিল জুরিনের অনুমতি। জুরিন নিজে এককথায় রাজি হয়ে যায়। সে পোড়-খাওয়া ট্যুরিস্ট গাইড।
নতুন হোম-স্টে’তে বিদেশি অতিথির প্রয়োজন মেটাতে সে সবসময় একপায়ে খাড়া। ইরিন বিকাশ ফিরে গিয়ে প্রশংসা করে দু’চারকথা বললে তবে তো আবার আরও অন্যরা আসবে এই গ্রামে।
যত মানুষ আসবেন, বাইরের দুনিয়ায় তত বেশি করে প্রচারিত হবে এই গ্রামের নাম।
কাজেই খুব দ্রুত একটার বদলে দুটো ঘোড়ার বন্দোবস্ত করে দিল জুরিন। বিকাশ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
একজন এগ্রিকালচারিস্ট হিসেবে তাঁর উৎসাহ ফারঘানা উপত্যকার চাষবাস নিয়ে। এখন যেমন এই বসন্তে আলুচাষ চলছে।
মে মাসের শেষে অন্তত ছয়-সাত টন আলু পাওয়া যাবে এই অঞ্চল থেকেই। তারপর শুরু হবে শসা আর তরমুজের চাষ। তিনি জুরিনের সঙ্গেই মাঠেঘাটে ঘুরে এইসব চাষ-আবাদ দেখতে চান।
ফসিল-বিশেষজ্ঞ ইরিনের কাজ নির্বিঘ্নে হলেই তিনি খুশি।
“আমি জায়গা দেখিয়ে দেব, আপনি ঠিক সেই জায়গাগুলোতে আপনার যন্ত্রপাতি দিয়ে মিলিয়ে নেবেন।”
আসিমভের কথার উত্তরে ইরিন বলেন, “এই অঞ্চলের পাথরের জিওলজিক এজ, মানে তাদের আসল বয়স জানাটাই প্রথম কাজ। সেটা আমি ওশ শহরে বসেই অনেকটা করে এসেছি। একটা জিওলজিক্যাল ম্যাপ তৈরি রয়েছে আমার কাছে। সেখান থেকেই বুঝতে পারি, জায়গাটা এখনও ভার্জিন রয়েছে। এখানে সভ্যতার পা পড়েনি। আমাদের কাজের জন্য একেবারে আদর্শ।”
ইরিন একটু আগে আগেই হাঁটেন। ঘোড়াদুটোতে চড়ে অনেকটা রাস্তা স্বচ্ছন্দে এসেছেন তারা। এবার ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হাঁটার পালা। রু আর ভানুর সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে আসিমভ। একবার ইংরেজিতে, একবার কিরগিজ ভাষায়। দুজনকেই এইভাবে ভাষা শেখানোর কাজও চলছে। মনে মনে খুব খুশি হন ইরিন। এই বিনিময় বড় জরুরি। ভানুও চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে এখানে। রুয়ের মতো এত ভালো ছেলে সত্যিই হয় না। অন্যমনস্ক ছিলেন বলেই বোধহয় ভীষণ জোরে হোঁচট খান ইরিন। পড়ে যাবার আগেই হাঁ হাঁ করে দৌড়ে আসে আসিমভ। ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন ইরিন। নিচু হয়ে তাকান একবার। পাথরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে গাছের শিকড়।
“এখানে আমরা বসি খানিকক্ষণ আসিমভ।”
আসিমভ এককথায় রাজি হয়।

“চলো রু, ভানু, আমরাও একটু ঘুরেফিরে দেখে নিই। আমাদের কিন্তু আজ থেকে মাটি চিনতে হবে, পাথর দেখে তার রঙ বুঝতে হবে, আর মনে মনে একদম মাটির তলায় পৌঁছে যেতে হবে।”
“আচ্ছা আসিমভ, তুমি কালকেই ওই জন্তুগুলোর কথা বললে কেন? তুমি কি জানতে ইরিন ওই জন্তুদের খুঁজতে এসেছে?”
রুয়ের প্রশ্নে বরাবর যুক্তি থাকে।
কিন্তু আসিমভ নিজেও জানে না, কেন সে ওই বিরাট জন্তুগুলোকে গলা বাড়িয়ে চরে বেড়াতে দেখেছিল।
উপত্যকার হাওয়ায় ভেসে থাকেন যেসব বিদেহী আত্মা, যাঁরা অনেকেই আসিমভের গার্ডিয়ান এঞ্জেল, তাঁরাই কি ওকে আগাম আভাস দেন সবকিছুর?
এই যেমন, ভানুকে দেখলেই ওর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে হাজার হাজার বছর আগে! কেন যে এত পুরনো ছবি ওকে টেনে ধরে, আসিমভ নিজেও সব সময় বুঝতে পারে না।

“আচ্ছা আসিমভ, এখানে যদি ওই জন্তুগুলোর খবর পাওয়া যায়, তাহলে কী এসে যায় আমাদের? কত কিছুই তো ছিল এই পৃথিবীতে, তারা মুছে গেছে, মরে গেছে, হারিয়ে গেছে। আবার নতুন কেউ এসেছে। নানী যে বলে, একটা নদী ছিল, তার নানীর কাছে শুনেছে সেই নদীটার কথা, সেই নদীটাও নেই এখন। তাতে কী এসে যায়? নেই তো নেই। যখন ছিল, আমরা তাকে দেখিনি। সেই সময়ের কেউ দেখেছে। নদীটা মরে গেল একদিন। এখন নদীর গল্প শুনি আমরা।”
রুয়ের কথায় চুপ করে থাকে আসিমভ, এই কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না ওর। ভানু ছুটে বেড়াচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা আশ্চর্য দৃশ্য ভেসে ওঠে আসিমভের চোখের সামনে।

লম্বা টানা উপত্যকা শুনশান। বড় গাছপালা প্রায় নেই। ঝোপঝাড়ই বেশি।
একটা বড় হাড়ের টুকরো হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে একটা ছোট্ট ছেলে। ও কী ভানু? কী বলছে ও? ‘এই দেখো, এই দেখো, কী বড় একটা দাঁত!’
“কী ভাবছ আসিমভ?” রুয়ের প্রশ্নে চিন্তা ছিঁড়ে যায়। স্বপ্নের মতো ছবিটাও হারিয়ে যায় একনিমেষে।
“কিছু বলছ রু?”

১১
প্যালেন্টোলজিস্ট হিসেবে ইরিনের যথেষ্ট সুনাম। নিজের কাজ সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী।
টানা তিন-চারদিন ধরে উপত্যকার বিভিন্ন অংশে ঘোরাফেরা করে, তার মাটির নমুনা পরীক্ষা করে তিনি রীতিমতো আশাবাদী।
এই কয়েকদিন তাকে রু আর আসিমভ ভীষণ সাহায্য করেছে। আসিমভ খুঁজে দেখিয়ে দিয়েছে পুরনো নদীখাত, রু বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে এনেছে নানান রকম পাথর।
ওদের উৎসাহ দেখার মতো। গ্রাম থেকে আসার সময় ব্যাগে করে কুড়ুল, ছুরি, ছোট কোদালের মতো হাতিয়ার সঙ্গে এনেছে ওরা। ইরিন দেখিয়ে দিয়েছেন, আনাড়ির মতো খুঁড়লেই হবে না।
যত্ন করে ধীরে ধীরে উল্টেপাল্টে দেখতে হবে।
আসিমভ ভারি সুন্দর করে কথা বলে। সে রু’কে বলছিল, “এই মাটি হল পৃথিবী। মাটি থেকেই তো আমরা সব পাই। মাটি বৃষ্টির জল ধরে রাখে, মাটি গাছের শিকড় ধরে রাখে। মাটির ওপরে আমরা পা রেখে উঠে দাঁড়াই, সে তো আমাদের সকলকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে বলেই। মাটিকে অত জোরে খুঁড়ো না রু। মাটি ব্যথা পাবে। কাঁদবে। কান পেতে শোনো, মাটির বুকের মধ্যে কত শব্দ, কত কথা।”
রু মাঝেমধ্যে উবু হয়ে শুয়ে মাটিতে কান রাখে। এক-এক জায়গায় একেকরকম আওয়াজ। কোথাও যেন শোঁ শোঁ করে শ্বাস পড়ছে কারও, কোথাও সাঁই সাঁই করে হাঁফ টানার আওয়াজ। কোথাও কান পাতলে স্পষ্ট শোনা যায় মিহি সুর। কোথাও ফিসফিস শব্দ।
রুয়ের মনে পড়ে মাঝে মাঝে শেষ রাতে ফিরে আসা সেই স্বপ্নটা। এইরকমই এক উপত্যকায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল প্রাণী।

আসিমভ বলে, “ওখানেও জুড়ে আছেন তাঁরা। এই পৃথিবীর সব আদি বাসিন্দারা। স্তরে স্তরে মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে তাদের পুরনো চেহারা। সব আলোর তলায় তারা অন্ধকারে সন্তর্পণে চুপটি করে বসে অপেক্ষা করেন। তারা ধরে রাখেন সমস্ত কিছু, এই আকাশ বাতাস জল জমি উপত্যকা… সব। আসছে যে কাল, সেই সময়টিকেও ধরে রাখে ওই জমি। ওই মাটিকে আদর করে রেখো রু।”
ভানু ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াতেই বেশি ভালোবাসে। নতুন কিছু পাওয়া গেলেই তার আনন্দ। ছুটে এসে দেখে, প্রশ্ন করে। আবার সব খবর জেনেশুনে দৌড়ে খেলতে চলে যায়।
ওরা থাকাতে ইরিনের দারুণ ভালো লাগছে। এ যেন এক অন্যরকম আবিষ্কার। এর মধ্যে বিজ্ঞানীসুলভ অনুসন্ধিৎসার চেয়েও বেশি জুড়ে রয়েছে অজানাকে জানার খোঁজ। অসমবয়সীরা মিলে এক আশ্চর্য নেশায় মেতেছে সকলে।

গোলমাল শুরু হল অন্য দিক থেকে।
বাকিয়েভের ভালো লাগছিল না এইসব অহেতুক খোঁড়াখুঁড়ি।
সে তার নিজের দুটো ঘোড়া দিয়েছিল ঠিকই, তার বিনিময়ে যা সোম (কিরগিজস্তানের টাকাকে বলা হয় ‘সোম’) চেয়েছিল, ইরিন তাকে তাই আগাম মিটিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু ওখানকার কাজকর্ম বাকিয়েভের একদম পছন্দ হল না। সে বেঁকে বসল। সে আর তার ঘোড়াদুটোকে অতদূর যেতে দেবে না।
প্রথমেই সে এসে জানায় জুরিনকে।

“জুরিন, কাল থেকে আমার ঘোড়া আর যাবে না ওইদিকে।”
সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে উপত্যকায়। আকাশের তারা জ্বলে উঠছে একে একে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আগুন দিয়ে তৈরি আলো ছিল এই প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ধের পর একমাত্র ভরসা। এখন প্রায় প্রতিটি বাড়ি বা তাঁবুর ওপরে সোলার প্যানেল রয়েছে। ফলে সন্ধের পরে সৌরশক্তিতে আলো জ্বলে, ছোটখাটো যন্ত্রও চালানো যায়। জুরিন একটা কেটলিতে চায়ের জন্য জল গরম করছিল। চমকে তাকায়।
“সে আবার কি বাকিয়েভ? ওরা প্রায় একমাস থাকবেন এখানে। তোমাকে অনেক টাকা আগাম দিয়ে দিয়েছেন।”
“সে টাকা আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি জুরিন। কিন্তু ওখানে আমার ঘোড়া আর যাবে না। এমনিই ছবি-টবি তুলবেন শুনেছিলাম। এখন তো দেখছি মাটি খুঁড়ছেন, পাথর খুঁড়ে তুলে নিয়ে এসে জল-টল দিয়ে ধুচ্ছেন। ধুলোবালি ঝেড়ে কী যে উনি খুঁজছেন, সে উনিই জানেন। আমার মোটেই ভাল্লাগছে না ব্যাপারটা। জায়গাটা এমনিই অনেক দূর। খুব একটা সুনাম নেই, তুমিও জানো সে কথা। আমরা কেউ ওদিকে কোনও কাজেই যাই না। নেহাত গ্রামে এসেছেন, ট্যুরিস্ট বলে…” বাকিয়েভ যে কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল, তা’ হল, ট্যুরিস্ট এসেছেন তোমার হোম-স্টে’তে থাকতে, আমরা সবাই তাকে স্বাগত জানিয়েছি, ব্যস, ওই অবধিই। তার বেশি দায়িত্ব বা ঝুঁকি কোনওটাই নিতে পারব না।

জুরিন বেশ বোঝেন, বাকিয়েভ ঘোড়া না দিলে গ্রামের আর তিন-চারটি পরিবারও বেঁকে বসবে। ওই উপত্যকা নিয়ে এমনিই কম-বেশি অস্বস্তি রয়েছে সকলের।
জুরিন নিজেও তার মায়ের কাছে ছেলেবেলায় বহু গল্প শুনেছেন। তাঁর অবশ্য কোনওটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কবে ওখানে কে কী কুড়িয়ে পেয়েছিল, তারপর সে মরণাপন্ন হয়ে পড়ে, তাই নিয়ে এতবছর পরে হইচই করার মানেই হয় না।
কাজের সূত্রে দেশের বহু জায়গায় ঘোরেন জুরিন, ইতিহাস ভূগোলের বহু কাহিনি তাঁর কণ্ঠস্থ। কিন্তু আদিম পৃথিবীর জীবজগৎ নিয়ে তাঁর কোনওদিনই তেমন উৎসাহ নেই। বেশ বুঝেছেন, ইরিন মাটির তলায় এক পুরনো জগতের খোঁজ করছেন। এটা তাঁর কাজ। এই নিয়েই তাঁর পড়াশোনা। জুরিন তাঁর সরল বুদ্ধিতে বোঝেন, যে বিষয় নিয়ে বড় বড় লোকেরা পড়াশোনা করেন, তার মধ্যে অলৌকিক বা কুসংস্কার থাকতেই পারে না।
কিন্তু জুরিন যা বোঝেন, এই গ্রামের সকলে এখনও সেইভাবে ভাবতে প্রস্তুত নন।
অগত্যা জুরিন শরণাপন্ন হলেন আসিমভের।

পরদিন সকালে আসিমভ আসামাত্র জুরিন তাকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে যান একটু দূরে। ইরিন বা রু কেউ যেন টের না পায়।
“খুব বিপদে পড়েছি আসিমভ। বাকিয়েভ তার ঘোড়া দেবে না বলেছে। আজ তোমরা অতদূরের পথ যাবে কী করে? আমি ইরিনকে কী বলব?”
আসিমভ গম্ভীর হয়ে যায়। আগেই যে এই আশঙ্কা সে করেনি, তা’ নয়।
“আজকের দিনটা সেক্ষেত্রে অতদূর যাওয়া যাবে না জুরিন। তুমি ইরিনকে বুঝিয়ে বলো, কাল আমি নিজে ঘোড়া নিয়ে চলে আসব।”
“বেশ। সে আমি বলছি। কিন্তু তুমিও সঙ্গে থাকলে ভালো হয়। বুঝতেই পারছ, উনি আমাদের অতিথি। আমরা ওঁর জন্য সামান্য একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারব না? মাসখানেক পরে তো চলেই যাবেন। আর ওঁর সব কাজকর্ম তুমি নিজেই কাছে থেকে দেখছ। তোমার কী মনে হয়, উনি কোনও অন্যায় করছেন?”
“একদমই নয় জুরিন। এটা ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়ই নয়। উনি যা করতে চাইছেন, তাতে এই উপত্যকায় আলো জ্বলে উঠবে একদিন। অনেক মানুষ আসবেন দূর-দূরান্ত থেকে। কত লোক এই গ্রামকে চিনবেন, জানবেন। আগেও এসেছেন যারা, তারাও কত কী দিয়ে গেছেন বলো। সিল্ক রুট দিয়ে যারা সেই বহু বছর আগে দল বেধে ব্যবসা করতে এসেছেন, তাদের কাছে আমাদের কম ঋণ?”
আসিমভ আর জুরিন দুজনে মিলে ইরিনকে বুঝিয়ে বলে, একটা দিন ঘোড়া পাওয়া যাবে না অতদূরে যাবার জন্যে। তার চেয়ে বরং কাছেপিঠে ঘুরে আসুক তারা।
ইরিন রাজি হয়ে যায়। এছাড়া আর কোনও উপায়ও তো নেই।
সবাই মিলে ঠিক হয় কাছাকাছি কিছুদূর অবধি হেঁটে যাওয়া হবে।
ইরিন বলেন, “আজ আমরা ফুল আর পাখি চিনব, চলো ভানু, রু আমাদের এখানকার সব ফুল আর পাখি চিনিয়ে দেবে।”

ভানুর সবেতেই ফূর্তি। সে লাফাতে লাফাতে এগোয়। এগোতে এগোতে দেখায়, কোথায় সে আগের দিন গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।
ইরিন থমকে দাঁড়ান একবার। সেই টিলার কাছে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলেন রু আর ভানুর। একই উচ্চতার দুই চনমনে কিশোর।
সদ্য শৈশবকে টা টা করে কৈশোরে পৌঁছেছে। সরল কৌতূহল টগবগ করে ফুটছে মনের মধ্যে। চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন।
“আসিমভ, এই জায়গাটা ফুলে ফুলে ভর্তি দেখছি। এই সব ফুলের নাম তুমি জানো?”
ছোট ছোট ঘাসফুল আর বুনো ঝোপেঝাড়ে অজস্র ফুল। পোকামাকড়ের ভিড়। ফুলের গন্ধে, মধুর টানে।
“নাঃ, সব ফুলের নাম হয় না। আমরা রঙ দিয়ে মনে রাখি, গন্ধ মনে রাখি। কখনও তার থেকে কোনও ওষুধ তৈরি করা গেলে মনে রাখি। কোন ঋতুতে ফোটে, সেটুকুই জানি। তা’ না হলে প্রায় সব ফুলই বুনো ফুল।”
আগের দিনের মতোই ছুটোছুটি করছিল ভানু, এবং যথারীতি আগের দিনের মতো না হলেও আবার হোঁচট খেয়ে ঢালু অংশে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল। প্রথম থেকেই রু ভীষণ সতর্ক ছিল এবার। চট করে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরে ভানুকে।
“আই টেল ভানুস্কা, নট গো। নট গো। হিয়ার মি। ইউ হিয়ার নো।” ওর ব্যকরণবর্জিত ভাঙা ইংরেজি বুঝতে আজকাল একটুও অসুবিধে হয় না ভানুর। ও খিলখিল করে হাসে।
ভানু যে কথাটা বলে না, তার হাঁটুর পিছন দিকে একটা কাঁটার মতো বিঁধেছে। জ্বালা করছে বেশ। ভাবে, গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবাকে দেখাবে। বাবা বুঝেশুনে ওষুধপত্র লাগিয়ে দেবেন।
চড়া রোদে বেশিক্ষণ না থেকে সেদিন তাড়াতাড়িই ফিরে আসে সকলে। আসার সময়ে ইরিন মৃদু গলায় বলেন, “আসিমভ, শুধু ঘোড়া নয়, আমি তাঁবু নিয়ে যাব এবার। আমাকে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে ঐ জায়গাটায়। তা’ না হলে কাজ এগোবে না। তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?”
আসিমভ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর মাথা নেড়ে বলে, “পারব ইরিন।”
গোলমাল বেশ ভালো রকম পাকিয়ে ওঠে তার পরদিন সন্ধ্যায়। আসিমভ রু আর ভানু বিকেলে ফিরে আসে। ইরিন থেকে যান ওই উপত্যকায়। একা। তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আসিমভ। একটা ঘোড়াও রেখে আসে সে। হঠাৎ যদি কোনও প্রয়োজন হয়, ইরিন যাতে ফিরে আসতে পারেন।
বিকাশ সবই জানতেন। তাঁর হেলদোল নেই। জুরিন গম্ভীর হয়ে যান। সবথেকে সোরগোল করেন নানী।
“এটা একদম ঠিক কাজ করলে না তোমরা। খুব অন্যায়। ওইখানে গভীর রাতে অশরীরী আত্মা নেমে আসে। তাদের নিজেদের জায়গা ওটা। তার ওপর আজ আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠবে বলে জানি।”
পূর্ণিমা শুধু নয়; ব্লু মুন। সেইরকমই বলছিলেন বিকাশ। একই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার পূর্ণিমা। খুব অস্বাভাবিক যেমন নয়, তেমন একই মাসে এই দ্বিতীয় পূর্ণিমা নিয়ে লোককথার শেষ নেই।
ভানু চুপ করে বাবার কাছে গল্প শুনছিল। পায়ে বেশ ব্যথা করছে তার। বাবাকে দেখিয়েছে। ওষুধপত্র লাগিয়ে দিয়েছেন বিকাশ।
তবু ভানুর মনে হচ্ছে হাঁটুর ঠিক পিছনে বিঁধে রয়েছে কিছু। যদিও খালি চোখে বিকাশ কিচ্ছু দেখতে পাননি। শুধু মৃদু বকুনি দিয়েছেন ভানুকে।
ব্যথার ওষুধ খেয়ে একটু একটু করে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ভানু। তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পায় বাঁশির আওয়াজ। বাঁশি বাজাচ্ছে আসিমভ।
আজ সে থেকে গেছে এই গ্রামে। রু নিশ্চই আজ অনেকরাত অবধি গল্প শুনবে আসিমভের কাছে।
ভানুর একটু একটু কান্না পায়। রু ওর পাশে এসে শুয়ে থাকলে আসিমভ নিশ্চই ওদের দুজনকেই গল্প বলত।
অনেক দূরের সেই পাহাড়টার কাছে মা এখন কী করছে?

 

১২
রাতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ একেবারেই এগোয় না।
কিন্তু সারা রাত খোলা আকাশের নিচে বসে থাকলে জায়গাটার সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়।
ইরিন সেটাই চাইছিলেন। এই জায়গাটা তাঁকে আপন করে নিক। এখানে তিনি বাইরের মানুষ হয়ে আসতে চান না।
তিনি ওদেরই একজন। ভালোবেসে কথা বলতে চান ওদের সঙ্গে। মাটির তলা থেকে খুঁজে বের করে আনতে চান ওদের না-বলা কথা। কেন হারিয়ে গেল, কবে শেষবারের মতো তারা নিঃশ্বাস নিয়েছিল এই পৃথিবীতে… সব জানতে হবে। ওদের পাশে না থাকলে ওরা ধরা দেবে না।
এইসব উপত্যকার প্রাচীন বিশ্বাস আর উপকথা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ইরিন। তাঁর নিজেরও মনে হয়, এই প্রাচীন লোককাহিনির মধ্যেও কিছু বিজ্ঞান রয়েছে। কিন্তু শ্রুতিনির্ভর কাহিনিতে রঙ চড়ে। প্রতিটি প্রজন্ম নতুন কোনও ধারণা বা ভাবনা জুড়ে দেয়। তাতেই হয়ত কাহিনি গল্প হয়ে থেকে যায়, তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
বেশ কয়েকটি জায়গা ম্যাপিং করে খুঁটি পুঁতে ঘিরে নিয়েছেন ইরিন। কাল ভোরের আলো ফুটতেই পুরোদমে মাটি সরাতে হবে। ক্লান্ত হবার আগেই আসিমভরা এসে যাবে নিশ্চই। তিন-চারটে জায়গা থেকে সামান্য নমুনা পেলেই শহরে ফিরে যাবেন ইরিন। রিসার্চ আর ফীল্ড ওয়ার্কের বড় টিম নিয়ে তারপরে আসার পালা। তবে তার জন্য এখনও অনেকদিনের অপেক্ষা। সরকারি নির্দেশ ছাড়া বা রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া দেশের যে কোনও জায়গায় কোনও রিসার্চ ইন্সটিট্যুট ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করতে পারে না। অনেক আইন-কানুন মেনে কাজ করতে হয়। তার আগে ইরিন প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানের কাজটি একেবারে ফুলপ্রুফ করে জমা দিতে চান।
চোখ জ্বালা করে। ঘুম আসে না। আকাশে ঝকঝক করছে পুর্ণিমার চাঁদ।

পরদিন ভোর না হতেই ঘুম ভেঙে যায় রুয়ের। ভানুস্কা কেমন আছে? রাতে শুনেছিল ওর পায়ে ব্যথা। কেন ব্যথা হল? অত দৌড়য় ছেলেটা! পড়েও যায়। অথচ ওর একটা পা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়, হাঁটার সময় পা টেনে হাঁটে। তবু ও দৌড়বেই। রু ছটফট করতে থাকে ভানুর কাছে যাবার জন্যে।
আসিমভ উঠে পড়ে সূর্য ওঠার আগেই। সকলে মিলে খাবারের আয়োজন করছে। তখন বিকাশের গলা পায় রু।
আসিমভ হেসে বলে, “গুড মর্নিং।”
বিকাশ আনমনা হয়ে ‘গুড মর্নিং বলে পালটা হাত বাড়িয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর চোখমুখ দেখে আসিমভ আঁচ করে কিছু।
“এনি প্রবলেম? থিংকিং অফ ইরিন? শী উইল বী ফাইন দেয়ার। ডোন্ট ওরি।”
“আমি ইরিনের কথা ভাবছি না। ভানুর জ্বর এসেছে রাতে, বার বার বলছে পায়ে ব্যথা, কী যেন ফুটে আছে। অথচ কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ওই পা’টাই ওর ভাঙা।”
আসিমভ ছটফট করে ওঠে। “আমি একটু দেখতে পারি ভানুকে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ এসো।”
আসিমভ বিকাশের সঙ্গে ঢোকে ওদের তাঁবুতে। ভানু ঘুমোচ্ছে। ফর্সা মুখ জ্বরের ঘোরে সামান্য লাল। কপালে হাত দেয় আসিমভ। একটু গরম।
যেই পায়ে ব্যথা লেগেছিল, সেই পা’টা হাঁটুর কাছে সামান্য ফোলা। ফর্সা পায়ে কাটাছড়ার দাগ নেই কোনও। আসিমভ ভানুর কপালে হাত বুলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে, বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “চিন্তার কিচ্ছু নেই। দুয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকের দিনটা বিশ্রাম নিক বরং। আমি রু’কে বলছি। সারাদিন ওর পাশে বসে থাকবে। আমি খাবারদাবার নিয়ে ইরিনের কাছে যাচ্ছি।”
“ইরিনকে কিছু বোলো না আসিমভ। ও নিশ্চিন্তে কাজ করুক। ভানুকে আমরা এখানে সকলে মিলে ঠিক সামলে নেব এখন।”
আসিমভ বাইরে আসে। রু’কে বলতে হবে অনেক কিছ দিয়ে ভানুকে যেন ভুলিয়ে রাখে। ব্যথা ভুলে থাকার একটাই ওষুধ। অনেক গল্প করে যাওয়া। রু’কে ডেকে বলতে হবে, আজ ঘরে বসে ইংরেজি আর কিরগিজ ভাষা ঝালিয়ে নেবার পালা। দেখা যাক, সারাদিনে কে ক’টা নতুন শব্দ শিখতে পারে।

ঘোড়ায় চড়ে একাই রওনা হয় আসিমভ। ইরিনের কাজ কতটা এগোল তা’ নিয়ে তার কৌতুহলও কম নয়।
দূর থেকে আসিমভকে একা আসতে দেখে একটু অবাক হন ইরিন। নির্ঘাত বাচ্চাদুটোর আর ভালো লাগছে না রোদের মধ্যে এই খোঁড়াখুঁড়ি।
ইরিনের মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখে নিজেই বলে আসিমভ, “ভানু একটু কাহিল। তাই রু আজ ভানুকে পাহারা দিচ্ছে। আমি একাই এলাম। তোমার খাবারদাবার এনেছি। আগে খেয়ে নাও। ততক্ষণে বলো কতটা এগোতে পারলে।”
“রাতে দিব্যি লাগছিল। আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো। কতদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়… পাহাড়গুলো কড়া হয়ে পাহারা দিল আমায়… ঘুম হয়নি তেমন। আমি প্রায় সারা রাত বাইরে বসে অন্ধকারের শব্দ শুনেছি। খুব ভালো লাগছিল।”
আসিমভ হাসিমুখে তাকায়। প্রকৃতিকে পড়তে গেলে, তাকে আগে জাপটে ধরে ভালোবাসতে হবে। ইরিনের মধ্যে সেই আঁকড়ে ধরার মন আছে। নীরস বিজ্ঞানী নয় সে।
“ওই ঘেরা জায়গাটা?” আঙুল দিয়ে খুঁটি পুঁতে ঘিরে রাখা জায়গাটার দিকে দেখায় আসিমভ।
ইরিন দূরে একটা চৌকোমতো জায়গা দেখিয়ে দেন।
অনেকটা বড় একটা আয়তক্ষেত্রের মতো জমি। ধুলোমাটি সরিয়ে ঝকঝকে। পাথর সরানো হয়েছে। ব্রাশ দিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে পাথরের গায়ের ধুলো সরিয়ে সেই ধুলো জমা করে রাখা আছে ছোট বড় কাঁচের শিশিতে। ইরিন দেখিয়ে দেন এই জায়গাটা জুড়েই কোনও ফসিল থাকার সম্ভাবনা প্রবল। কোনও বড়সড় চেহারার জন্তুর শরীরের হাড়ের টুকরো পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। প্রচণ্ড ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে একটু একটু করে তার কাছে পৌঁছতে হবে।
আসিমভ আর ইরিন কাজে হাত দেন। ইরিনের অভিজ্ঞ হাত, সন্ধানী চোখ। আসিমভের ভরসা মাটির নিজস্ব ভাষা। ওই মাটিই তাকে কানে কানে বলে দেবে অজানা প্রাণীর খোঁজ।

বেলা যত গড়ায়, ভানুর মনে হয় পায়ের পিছনদিকে ব্যথাটা চিনচিন করে বাড়ছে। রু ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারে, ভানুর কষ্ট হচ্ছে। একটা হাত দিয়ে সে শক্ত করে ধরে থাকে ভানুর হাত। আরেকটা হাত দিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। নানী যেমন করে।
“তুমি গান জানো রু?” ভানু জিগ্যেস করে রু’কে। রু বোঝে না বাংলা ভাষা। তবু তাকিয়ে থাকে ভানুর ঠোঁটের দিকে। “আমি ছোটবেলা অনেকগুলো গান শিখেছিলাম, জানো? শুনবে? দাঁড়াও গাইছি,” গুনগুন করে গেয়ে ওঠে ভানু, “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি… আ হা হা হা হা”। ভানুর কচি গলায় ‘আ হা হা হা হা’ সুরটা দুলিয়ে দেয় রু’কে। ও মা! ভারি সুন্দর সুর তো। রু ভানুর ঠোঁটে আঙুল রাখে, সুর তুলে নিতে চায় নিজের গলায়। ওই জায়গাটা, আ হা হা হা হা।
“ভানুস্কা, আবার করো। ওই যে আ হা হা হা হা…”
ভানু একগাল হাসে। দুজনে মিলে একসঙ্গে সুর মেলায়, মাথা নেড়ে নেড়ে গাইতে থাকে শুধু ওইটুকুই। আ হা হা হা হা।
বিকাশ আজ বেশি দূরে যাননি। তিনি খোঁজ নিচ্ছেন বারেবারে। ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছেন, মলম, স্প্রে সবই লাগানো হচ্ছে। তবু ভানুর পায়ের ব্যথাটা আসছেই। বিকাশ ঠিক করেন, ব্যথা বা জ্বর কোনওটাই পুরোপুরি না কমলে ইরিন বরং থেকে যাবেন এখানে, তিনি ভানুকে নিয়ে শহরে ফিরবেন। ডাক্তার দেখাতেই হবে। এই প্রত্যন্ত গ্রামে সময় নষ্ট করে ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবলেন, জুরিনকে আগেভাগে জানিয়ে রাখতে হবে সবটা। জুরিনের খোঁজ করতে বাইরে আসেন তিনি।
জুরিনের কাঠের ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান বিকাশ। ভেতরে খুব উত্তেজিত কথাবার্তা চলছে। জুরিনের গলা কম, নানীর জোরালো গলার আওয়াজই বাইরে থেকে স্পষ্ট শোনা গেল। বিকাশ ডাকলেন না কাউকেই। কথার মধ্যে ডাকডাকি করাটা অভদ্রতা। চুপ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। যখন ভাবছেন, এবার চলেই আসবেন, পরে নাহয় কথা বলে নেবেন জুরিনের সঙ্গে, ঠিক তখনই নানীর উত্তেজিত কথার মধ্যে ট্যুরিস্ট শব্দটা কানে আসে তাঁর। ও, তার মানে, তাঁদের নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। এমনিতেই বিকাশ আভাস পেয়েছেন, উপত্যকায় যাওয়া এবং সেখানে ইরিনের কাজকর্ম এখানে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। সরকারি লোক দল বেধে এলে হয়ত কিছু ঘটত না, কিন্তু বেড়াতে আসার নাম করে কোনও বিদেশি এসে তাদের প্রাচীন উপত্যকায় অহেতুক কাজকর্ম শুরু করলে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক।
অস্বস্তি বোধ করেন বিকাশ।
উলান আর ওতুন পাশের দুটো বাড়িতে থাকে। জুরিনের প্রতিবেশী এবং বন্ধু। ওরাও সকাল থেকে বিকাশকে কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল। নাকি বিকাশের মনের ভুল। বিকাশ ধীরে ধীরে ফিরে আসেন। ইরিন বড্ড আবেগপ্রবণ। ওর পাগলামি, হ্যাঁ এখন এটাকে পাগলামিই মনে হচ্ছে বিকাশের, এইভাবে হুট করে ওর কাজ শুরু করা উচিত হয়নি।
মন শক্ত করেন বিকাশ। প্রয়োজন হলে আজ-কালের মধ্যে ইরিনকেও সঙ্গে করে শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভানুর অসুস্থতার মোক্ষম অজুহাত তো আছেই।
নানী তখন জোর গলায় বোঝাচ্ছেন জুরিনকে, ওই উপত্যকার অপদেবতাদের অভিশাপেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভানু। জুরিন কেবল লক্ষ্য রাখছিলেন, তাদের এই আলোচনার মধ্যে রু কোনওভাবে ঢুকে পড়ে কিনা। ভানুকে রু পাগলের মতো ভালোবাসে। এইসব শুনে রু কী করবে বোঝা মুশকিল।

উপত্যকায় বেলা গড়িয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ গোটাতে থাকে ইরিন। তার চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনায়।
যে বিশাল একটি কাঠামোর আভাস পাচ্ছেন মাটির তলায়, তার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
“আসিমভ, আমি জানিনা কী পাব। তবে বিশাল কোনও জন্তুর দেহের খাঁচা লুকিয়ে রয়েছে মাটির তলায়, আমি নিশ্চিত। আমাদের দু’জনের পক্ষে এই কাঠামো খুঁড়ে বের করা অসম্ভব। আমি শুধু ছবি তুলে নমুনা নিয়ে আভাস পেতে চাইছি তার বিশাল চেহারার।”
“আজও কী রাতে থাকার প্ল্যান এখানে?”
“অবশ্যই আসিমভ। ওর সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন আমি থাকতে চাই।”
আসিমভ চোখ বন্ধ করে একবার। উপত্যকায় চাঁদোয়ার মতো টাঙানো আকাশে নেমে আসা বিকেলের আলোতে সে ছুঁয়ে থাকে তার অন্য পৃথিবীর বন্ধুদের। তাদের স্মরণ করে সে। প্রার্থনা করে আসিমভ, সুরক্ষিত থাক ইরিন। মৃত সভ্যতার অবশেষ উঠে আসুক হাতের নাগালে। নতুন পৃথিবীর জীব-মানচিত্রে কোথাও জুড়ে থাকুক ইরিনের নাম।

(চলবে)