Categories
ইতিহাসতলা |

নোবেল পুরস্কারের গল্প

56 |
Share
| ২৮ জুন, ২০২৪
অমরনাথ রায়

চিত্রঋণ/ উইকিপিডিয়া

সুইডেন দেশের রাজধানী স্টকহোম শহরেই জন্মগ্রহণ করেন আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল (Alfred Bernhard Nobel) ২১ অক্টোবর, ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে৷
১৮৪৭ সালে ইউরোপে নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerine) আবিষ্কৃত হল ৷ আবিষ্কার করলেন ইতালির একজন বৈজ্ঞানিক৷ নাম তাঁর সোব্রেরো (Ascanio Sobrero)৷ নাইট্রোগ্লিসারিন হল হলদে রঙের একরকম তরল রাসায়নিক দ্রব্য৷ ভীষণ বিস্ফোরক পদার্থ৷ একটু নাড়াচাড়া বা একটু গরম করলেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে যায়৷

নোবেলের বয়স তখন চোদ্দ বছর মাত্র৷ এই অল্প বয়সেই নোবেলের বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ প্রবল৷ বালক নোবেল শুনলেন এই আবিষ্কারের কথা৷ দেখলেন জিনিসটি, মনে মনে সংকল্প করলেন— আমিও আবিষ্কার করব এমনিই কোনো বিস্ফোরক পদার্থ৷ অল্প বয়সেই নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন নোবেল৷ গবেষণা করতে গিয়ে অনেকবার তাঁর জীবন বিপন্ন হল৷ তবুও আশা ছাড়লেন না তিনি৷

একদিন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল৷
কোনো এক রেল স্টেশনে পড়ে ছিল এক বাক্স নাইট্রোগ্লিসারিন৷ রাতের ঠান্ডায় জমে গিয়ে তার আয়তন গিয়েছিল বেড়ে৷ ফলে বাক্সটি গেল ফেটে৷
ভোরবেলায় এক কুলির নজর পড়ল ঐ ফাটা বাক্সটির ওপর৷ কুলি মতলব আঁটল পেরেক মেরে বাক্সটিকে সে ঠিক করবে৷ সে নিয়ে এল পেরেক আর হাতুড়ি৷ বাক্সের ওপর পেরেক রেখে বসাল হাতুড়ির ঘা৷ বুম . . .
পলকে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল৷ ভীষণ শব্দে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল৷ রেল স্টেশনের খানিকটা গেল উড়ে৷ মারা গেল কয়েকজন লোক৷

এমনিই ভয়াবহ বিস্ফোরক দ্রব্য নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমনিভাবেই একদিন ধবংস হয়ে গেল নোবেলের গবেষণাগার কিন্তু ভাগ্যক্রমে নোবেল গেলেন বেঁচে৷ তবুও আশা তিনি ছাড়লেন না৷ নতুন উদ্যমে আবার তিনি গবেষণা আরম্ভ করলেন৷

আর একটি ঘটনা৷ নোবেলের এক সহকর্মী একদিন কয়েক বোতল নাইট্রোগ্লিসারিন প্যাক করছেন৷ বিদেশে পাঠাতে হবে৷ হঠাৎ হাত ফস্কে একটি বোতল পড়ে যায় মেঝেতে৷ মেঝেতে ছিল বালি, বালির ওপর পড়েও বোতল যায় ফেটে৷ সবাই তো ভয়ে অস্থির৷ এখনই হয়তো ঘটবে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে সব৷

কিন্তু অবাক কাণ্ড, বিস্ফোরণ ঘটল না৷ নোবেল ভাবলেন বোতলে হয়তো নাইট্রোগ্লিসারিনের বদলে আছে অন্য কিছু৷ তখনই ফাটা বোতলের মধ্যেকার জিনিস পরীক্ষা করলেন নোবেল৷ দেখা গেল— অন্য কিছু নয়, ওটা নাইট্রোগ্লিসারিনই৷ তবে? আবার পরীক্ষা চালালেন নোবেল৷ তিনি দেখলেন যে বালির সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসারিন মিশলে তা জমাট বেঁধে কঠিন হয়৷ ফলে নাইট্রোগ্লিসারিন নাড়াচাড়া করার পক্ষে বেশ নিরাপদ হয়৷ নোবেল তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, যে-জিনিসের শোষণ করার ক্ষমতা আছে তা
নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে ইচ্ছেমতো বিস্ফোরণ ঘটানো যায়৷ এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে নোবেল আরও পরীক্ষা চালালেন৷

‘কিসেলগার’ (kieselguhr) হল এক রকম সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত বেলে পাথর৷ নোবেল নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে কিসেলগার মিশিয়ে দেখলেন যে, নাইট্রোগ্লিসারিন বেশ কঠিন হয়েছে৷ নাড়াচাড়া করারও বেশ সুবিধে৷ শুধু তাই নয়, এতে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ-শক্তিও কমে নি৷

এইভাবে নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে কিসেলগার মিশিয়ে এক নতুন বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করলেন নোবেল৷ তার নাম দিলেন তিনি ‘ডাইনামাইট’৷ সেটা ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ৷

ছেলেবেলায় নোবেল যে সংকল্প করেছিলেন তা সিদ্ধ হল৷ দেখা গেল ঐ নতুন বিস্ফোরক দ্রব্য ‘ডাইনামাইট’ খুবই শক্তিশালী৷ এর সাহায্যে পাহাড়-পর্বত উড়িয়ে দেওয়া যায়৷ পাহাড়ের ভেতর সুড়ঙ্গ তৈরি করা যায়৷

এত বড় একটা আবিষ্কারের জন্যে নোবেলের নামে চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল৷ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন নোবেল৷ ডাইনামাইট থেকে প্রচুর অর্থও পেলেন তিনি৷ কিন্তু অর্থের অপব্যয় করেন নি নোবেল৷ নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে তিনি ১৭,৫০,০০ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ২,৪০,০০,০০০ টাকা দিলেন সুইডেনের নোবেল সমিতির হাতে৷

শর্ত হল, সমিতি ঐ টাকা খাটিয়ে যে সুদ পাবে তা থেকে প্রতি বছর পাঁচটি পুরস্কার দেওয়া হবে৷ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন-বিদ্যা, চিকিৎসা-বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং আন্তর্জাতিক শান্তির ক্ষেত্রে অসামান্য যাঁদের দান তাঁরাই ঐ পুরস্কার পাবেন৷ পুরস্কারের মূল্য বর্তমানে প্রায় সাত কোটি আটাশ হাজার টাকা৷ মহানুভব আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল-এর নাম অনুসারে ঐ পুরস্কারের নাম রাখা হল ‘নোবেল পুরস্কার’৷ আজকের দিনে ‘নোবেল পুরস্কার’ পাওয়া মানে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্মান লাভ করা৷

ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম এই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ সাহিত্যে তাঁর অসামান্য দানের জন্যে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই পুরস্কার পান৷

বিজ্ঞানী নোবেল ছিলেন শান্তিকামী৷ তিনি চান নি যে তাঁর ‘ডাইনামাইট’ ধবংসের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হোক, মানুষের অকল্যাণ করুক৷ ‘ডাইনামাইট’ শুধু মানব-জাতির কল্যাণে নিয়োজিত হবে— এই ছিল তাঁর আশা৷
তিনি মনে-প্রাণে শান্তি কামনা করতেন বলেই তো রেখে গেছেন বিশ্ব-শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার৷
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর ৬৩ বছর বয়সে নোবেল দেহত্যাগ করেন৷ নোবেল প্রাইজ দেওয়া শুরু হয় ১৯০১ সাল থেকে৷

(প্রথম প্রকাশ, বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৫৮) সম্পাদনা/মেঘমুলুক ডেস্ক, চিত্রঋণ/ উইকিপিডিয়া