Categories
ইতিহাসতলা |

দেড়শো বছরের ট্রাম

117 |
Share
| ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
রতন কুমার দাস

কৃতজ্ঞতা/ উইকিপিডিয়া

কলকাতা শহরে ঘুরতে এসে হোক কিংবা শহরের রাস্তায় এমনিই হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ। শহরের ওপর দিয়ে বিছিয়ে থাকা ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে যখন টুং টাং শব্দ করে ট্রাম এগিয়ে চলে, তখন তা দেখলেই মন নিজে থেকেই কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। সে যেন ছোটবেলার চিরপরিচিত এক বন্ধু। ভাবতেই অবাক লাগে পরিবেশ দূষণহীন এই যানটির বয়স প্রায় দেড়শো বছর! সত্যিই অবাক করার মতোই বিষয়। এত আধুনিক গাড়ি, দু’চাকা চার চাকার যান-এর পাশাপাশি ছুটে চলেছে দেড়শো বছর আগে উদ্ভাবিত হওয়া ঐতিহ্যময় ট্রাম।

এই ট্রামের সূচনার ইতিহাস কিন্তু বেশ মজার। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে কিভাবে কলকাতা শহরে ট্রাম এলো? চলো তাহলে, মনের টাইম মেশিনে করে পৌঁছে যাই দেড়শো বছর আগের কলকাতা শহরে।

তখন কলকাতা শহর এখনকার মতো যানজটে পরিপূর্ণ ছিল না। শহরে চলতো ঘোড়ায় টানা গাড়ি, পালকি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে কাজের সূত্রে মানুষ ভিড় করছিল এই শহরে। কাজেই জনসংখ্যা বাড়ছিল শহরের একটু একটু করে। প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল নতুন কোনো যানের, যার মাধ্যমে শহরের বুকে একসাথে অনেক লোক যাতায়াত করতে পারে। এরকমই এক ভাবনা থেকে কলকাতা শহরে ট্রামের সূত্রপাত ঘটে। বিভিন্ন আলোচনা, ব্যবস্থাপণার পর অবশেষে সেই দিন এসে উপস্থিত হল, যেদিন কলকাতা শহরের বুকে প্রথম ট্রাম তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করবে।

দিনটা ছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৩। কলকাতা শহরের বুকে এই দিনেই ট্রাম তার প্রথম যাত্রা শুরু করে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে। প্রথম ট্রাম কিন্ত এখনকার মতো বিদ্যুৎচালিত ছিল না, ছিল ঘোড়ায় টানা। প্রথম ট্রাম ছাড়ার কথা ছিল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকালবেলা ঠিক ৯টা বেজে ১৫ মিনিটে। ট্রামের প্রথম যাত্রা দেখতে উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছিল শিয়ালদহ চত্বরে। কথা ছিল তিনটে গাড়ি ছাড়া হবে সেখান থেকে। একটা ফার্স্ট ক্লাস আর বাকি দুটি সেকেন্ড ক্লাস। এখানে বলে রাখা ভালো, ফার্স্ট ক্লাসের বসার জায়গা গুলো ছিল গদিযুক্ত এবং নরম। অন্য দিকে সেকেন্ড ক্লাসের বসার জায়গা ছিল কাঠের তৈরি বেঞ্চের মতো। যাই হোক, প্রথমেই টগবগে দুটো ঘোড়া প্রতি ট্রাম গাড়ির সাথে জুড়ে দেওয়া হল।

ফার্স্ট ক্লাসের বগিতে ভাড়া বেশি থাকায় ৪৫-টি আসনের বগিতে বসল মাত্র পাঁচজন। এখানে বলে রাখা দরকার প্রথম ট্রাম থাকল বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। পাঁচজন যাত্রীর তিনজন সাহেব, দুইজন ভারতীয়। গাড়ি হালকা থাকায় দুই ঘোড়াতে সহজেই টেনে নিয়ে চললো সামনের দিকে। কিন্তু, সমস্যা হলো সেকেন্ড ক্লাস নিয়ে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় যে ট্রামবগি দুটি সেকেন্ড ক্লাস হিসেবে বিবেচিত ছিল, তার ভাড়া ছিল বেশ কম। ফলে সকলেই প্রথম ট্রাম যাত্রার সাক্ষী হতে চাইল এই সেকেন্ড ক্লাস বগিতে চেপেই। টিকিট কাটল প্রচুর সংখ্যক লোক।

বগির নির্দিষ্ট ৪৫ আসনে যাত্রীসংখ্যা ভর্তি হওয়ার পর মানুষ এবার উঠতে শুরু করল ট্রামের ছাদে। ছাদও যখন কানায় কানায় ভর্তি হল, তখন সবাই বাদুড়ের মতো ট্রামের গায়ে ঝুলতে শুরু করল। এখনকার শহরতলির লোকাল ট্রেনগুলিতে যেমন অবস্থা হয়, ঠিক তেমন। এই ভিড়ে ঠাসা ট্রাম কিন্ত দুই তেজিয়ান ঘোড়াতেও টানতে পারেনি। রেল কর্তৃপক্ষের বেশ কিছুজনকে হাত লাগাতে হয় ট্রামের পেছনে ঠেলতে। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর ঘোড়াগুলি ট্রামকে নিয়ে চলতে শুরু করে।

এভাবেই শুরু হয় কলকাতা শহরের বুকে ট্রাম যাত্রা। ঠিক তার পরের দিনই অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৩ ইংলিশম্যান কাগজে বড় বড় হরফে লেখা হয় প্রথম ট্রামযাত্রার খবর।

ঘোড়ায় টানা ট্রাম

তবে প্রথম ট্রামযাত্রা বা ট্রাম নিয়ে উন্মাদনা প্রথম দিকে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও তা আস্তে আস্তে কমে যেতে শুরু করেছিল। তার কারণ ছিল ঘোড়ার বিভিন্ন বিষয়ের খরচ এবং তাকে ঘিরে সমস্যা।

ট্রামগাড়ি চালাবার জন্য সূদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে যে সব দামি তেজিয়ান ওয়েলার ঘোড়া আনা হয়েছিল, তারা কলকাতার গরমের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারল না। ট্রাম টানতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ত, অনেক সময় মারাও যেত। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরের গরম ঘোড়ারা সহ্য করতে পারত না মোটেও।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কিছু দূরে দূরে রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো জলের পাত্র রাখার ব্যবস্থা হল, যাতে ক্লান্ত ঘোড়া একটু জল পান করে বিরতি নিয়ে পারে। এমনকি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর অন্তর আস্তাবল পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল বেশি দূরত্বের যাত্রাপথ হলে ঘোড়া বদল করে করে ট্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। অনেকটা শিফটে কাজ করার মতো। কিন্তু, এত সব করতে গিয়ে, খরচ হলো প্রচুর। লাভ তো দূরে থাক, বিনিয়োগ করা অর্থই উঠে আসত না। অবশেষে, সরকার বাহাদুরের অর্থ অপচয়ের কারণে ১৮৭৩ সালে ২০ নভেম্বর ঘোড়ায় টানা ট্রামের যাত্রা শেষ করতে বাধ্য হল। সাথে শেষ হল ট্রামের প্রথম পর্যায়ের ইতিহাস।

বিধান সরণীতে ট্রাম

অর্থাৎ বুঝতেই পারছো, ট্রামের জীবনে দ্বিতীয় পর্বও একটা ছিল। মানুষ চাইছিল ট্রাম আবার ফিরে আসুক। সরকারও মাল বহনের জন্য,এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রামের প্রয়োজন বোধ করছিল। অবশেষে, ১৮৭৯ সালের দিকে কলকাতায় গড়ে উঠল প্যারিশ আর সুটার কোম্পানির বদান্যতায় ‘কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’। ধীরে ধীরে সমস্ত শহর জুড়ে পাতা হলো সিঙ্গল এবং ডবল লাইন।
১৮৮০ সালের ১৩ই নভেম্বর শিয়ালদহ-বৌবাজার লাইনে দ্বিতীয় বারের জন্য ট্রাম চলতে শুরু করে।

দ্বিতীয় বারের এই ট্রামও ঘোড়ায় টানা হলেও এবার কিন্তু বেশ কিছু সংযোজন ও সংশোধন করা হয়েছিল। ট্রাম কোম্পানি লাভের মুখ দেখতে পেয়েছিল।

কালক্রমে সেই ঘোড়ায় টানা ট্রামই বিবর্তনের পথ ধরে আজ বৈদ্যুতিক ট্রামে পরিণত হয়েছে। প্রায় দেড়শো বছর কেটে গেছে ট্রামের জন্মলগ্ন থেকে। তবুও ঐতিহ্যের মোড়কে আজও তার রূপ সমানভাবে মায়াবী। বর্তমানের ট্রামের অবলুপ্তি নিয়ে শোরগোল উঠেছে, শহরকে তীব্র যানজট মুক্ত করতে ট্রাম থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে আলোচনা চলেছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু, আধুনিকতা গতিময়তাকে সঙ্গী করতে গিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলব না তো?—এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দিতে পারে।

পালকি থেকে পাতালরেল, সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়, উইকিপিডিয়া