Categories
পুজোর খাতা ২০২৪ |

পোড়োবাড়ির রহস্য ভেদ

106 |
Share
| ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সুমিতা চৌধুরী

চিত্রবিন্যাস/ কমলাকান্ত পাকড়াশী

দুষ্টুর নাম আর চরিত্রের মধ্যে বেজায় মিল। ইদানিং তার নেতৃত্বে পাড়ায় বাচ্চাদের একটা দলও গড়ে উঠেছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ এই দুষ্টুদের দলের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে তাদের খেলার মাঠ পেরিয়ে পাড়ার শেষ সীমান্তে একাকী পোড়োবাড়িটা।

বড়রা বলে, ওখানে গত ২০-২৫ বছর আগে এক পরিবারের বাস ছিল। হঠাৎই তারা কোনো কারণবশত অন্যত্র চলে যান, আর কখনো ফিরে আসেননি। বাড়িটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় অযত্নে পড়ে থেকে ইঁট-কাঠ বেরিয়ে, আগাছা জন্মে কেমন পোড়োবাড়ির চেহারা নিয়েছে। জায়গাটা এমনিতেই পাড়ার শেষ প্রান্তে, মাঠের কাছাকাছি, ফাঁকা, পাশাপাশি কোনো আবাস না থাকায় কেমন জানি একটা গা ছমছমে পরিবেশ। তাই সচরাচর ওখানে এখন আর কেউ যায় না। দুষ্টুরা খেলতে গিয়ে অনেক সময় বল-টল কুড়োতে ওখানে গেছে এক-আধবার। তবে তাদের বাবা মায়েরা বিকেলের পর আর খেলতে বারণ করে দিয়েছেন ওদের। বিশেষ করে মায়েরা তো পইপই করে বলে দিয়েছেন ওই পোড়োবাড়ির ধারকাছ না মাড়াতে।

বাচ্চারা এমনিতেই কৌতূহলী হয়। আর যেটা বারণ তার ওপর আকর্ষণ জন্মায় বেশি। তার ওপর এই পোড়োবাড়ি নিয়ে নানা গল্পকথা শোনা যায় এর-তার মুখে, সেটাও কম আকর্ষণীয় নয়। তাই অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় দুষ্টুদের দল ঠিক করল যে পোড়োবাড়ি অভিযান তারা করবেই, আর তারপরই সব রহস্যের কিনারা তারাই করবে। এইসব আজগুবি ভূতুড়ে কথায় তাদের মোটেই বিশ্বাস হয় না। তবে কাজটা করতে হবে নিজেদের মধ্যেই, অত্যন্ত গোপনে, বাড়ির লোক জানলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

বল কুড়োতে গিয়ে অনেক সময় তারা কাদের যেন ফিসফাস কথা বলার আওয়াজ শুনেছে। তাছাড়া নানারকম খুটখাট আওয়াজ, ফিসফিসানি কথা আর আলো-আঁধারিতে এই পোড়োবাড়ি এক তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে তাদের মনে। তারা সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার পথে দু’একবার রেইকি করেও এসেছে বাড়ির চারপাশটা। তাদের বারবারই মনে হয়েছে যে এখানে যেন কারা থাকে বা আসে।

তাছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে এক উৎপাত শুরু হয়েছে পাড়ায়। রাস্তার আলো, বিশেষত তাদের মাঠের ধারের আলোগুলো যতবার লাগানো হয়, দু’দিন যেতে না যেতেই সব আলো উধাও হয়ে যায়। প্রথমদিকে পাশের এলাকার বদমাশ ছেলেদের কাজ বলে পাড়ার ক্লাবঘর থেকেই আলো লাগিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এতবার বাল্ব চুরি হতে লাগল যে পাড়ার দাদারা ধৈর্যচ্যুত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। এমনিতেই, এখন পাড়ার বড় দাদারা বেশিরভাগই চাকরিবাকরি করে। শুধু শনি রবিবার ও ছুটিছাটা থাকলে ক্লাবঘর খুলে ক্যারাম খেলে। বাদবাকি দিন ক্লাবঘর বন্ধই পড়ে থাকে। যাইহোক, পাড়ার দাদারা হাত তুলে নেওয়ার পর দুষ্টুদের বারবার অনুরোধ উপরোধে তাদের বাবারাও নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বেশ কয়েকবার মাঠের ধারের লাইট লাগিয়েছেন। কিন্তু ইদানীং তাঁরাও রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। উল্টে দুষ্টুদের খেলার ওপর আরো কড়াভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। একটু সন্ধ্যা হলেই তাদের খেলা বারণ। এইসব নিয়ে তাদের মনে রাগও আছে ষোলোআনা। তাই সবদিক থেকে এই পোড়োবাড়ির রহস্য ভেদ করতে তারা আরো মরিয়া হয়ে উঠল।

আগে থেকে তৈরি করা প্ল্যানমাফিক এক রবিবার মেঘলা দুপুরের নিস্তব্ধতায় দুষ্টুদের দলের দশজন তিনটে দলে ভাগ হয়ে অ্যাডভেঞ্চার শুরু করল। প্রথমে দুষ্টু সবথেকে ডাকাবুকো তিনজন ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বাড়িটা দোতলা। দুষ্টুরা বাড়িটার দোতলায় কোনোদিন যায়নি। একতলার বারান্দায় বল কুড়োতে গিয়ে কখনো-সখনো জানলা দিয়ে একতলার ঘরের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে। এই প্রথম দোতলায় অভিযানে গেল তারা। তাই বিপদের আশঙ্কা বুঝে, প্ল্যানমাফিক আরো দুটো দল তৈরি হয়ে রইল। দ্বিতীয় দলে আরো চারজন বাড়ির পাশেই ওঁৎ পেতে রইল। আর তৃতীয় দলে দু’জন মাঠ আর পোড়োবাড়ির মাঝখানে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে দ্বিতীয় দলের ওপর নজর রেখে চলল।

প্ল্যানমাফিক আধঘণ্টা পার হওয়ার পরও দুষ্টুদের কারো দেখা পাওয়া গেল না। তখন দ্বিতীয় দলটি বাড়ির ভেতরে ঢুকল তৃতীয় দলকে ইশারায় জানিয়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে বিপদ সংকেতের মতো একটা তীক্ষ্ণ বাঁশির আওয়াজ পেয়েই তৃতীয় দল ছুটে গেল রবিবারে আড্ডারত ক্লাবের বড় দাদাদের কাছে। যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সবটা বলে তারা বড়দের কাছে সাহায্য চাইল। বড়রাও তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে পরিচিত একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর কাকুকে ফোনে সবটা বলল। সেই ইন্সপেক্টর কাকু সামনের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে একটি বড় পুলিশবাহিনী এনে বাড়িটাকে ঘিরে ফেললেন। তারপর খুব তৎপরতার সঙ্গে দুষ্টুদের বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ল ইদানীং এই অঞ্চলে গজিয়ে ওঠা এক ব্যাঙ্ক ডাকাতের কুখ্যাত দল।

ডাকাত ধরার খবর পেয়ে দুষ্টু ও তার দলের বন্ধুদের মায়েরা ভীষণরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। মায়েরা সকলেই খুব বকাবকি করেছিলেন দুষ্টুদের। কিন্তু ইন্সপেক্টর কাকু ও পাড়ার বড় দাদারা যখন দুষ্টু ও তার দলের প্রসশংসা করল, তখন সেই প্রশংসায় তারাও গর্বিত হয়ে নিজের ছেলেদের পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন।

বাড়িটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় সরকার সেটি হস্তগত করল যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ না সংঘটিত হয় সেখানে। দুষ্টুদের আলো ঝলমলে মাঠ আবার তার জৌলুস ফিরে পেল। আর বাড়তি পাওনা হিসেবে তারা পেল ঐ পোড়োবাড়ির জায়গায় নতুন তৈরি হওয়া একটি সুন্দর পার্ক। দুষ্টুদের এখন খেলার জায়গা একটা ছেড়ে দুটো আর বাবা মায়ের নিয়মের কড়াকড়িতেও একটু শিথিলতা এসেছে। আর কী চাই!

‘জয় দুষ্টু অ্যাডভেঞ্চার টিমের জয়, হিপ হিপ হুররে’।