কখনো ভাবিনি তিলোত্তমা কলকাতাকে ছেড়ে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম— বাগমুন্ডিতে গিয়ে আমাদের থাকতে হবে। কিন্তু অনিমেষের চাকরির সূত্রে আমাদের যেতেই হল। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত ছিল। অনিমেষ অবশ্য আমাকে বলেছিল, ‘মনোরম প্রাকৃতিক শোভায় ঘেরা, ভারী সুন্দর এই ছোট্ট গ্রাম বাগমুন্ডি। দেখো নন্দিনী, তোমার এখানে থাকতে বেশ ভালোই লাগবে।’
সত্যিই তাই। যখন পুরুলিয়া স্টেশন ছাড়িয়ে, আমাদের মারুতি ভ্যান পাহাড়তলির শাল, শিমুল আর পলাশের ঘন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত ছোট ছোট বসতিগুলো পেরিয়ে, আঁকা-বাঁকা কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল, তখন চারপাশের সবুজ দেখে মন জুড়িয়ে গেল।
সূর্যাস্তের কমলা আলো আর পলাশের কমলা রং মিলেমিশে প্রকৃতিকে বড় অপরূপা দেখাচ্ছিল! আমার পাঁচ বছরের মেয়ে মিঠুর সে কী উচ্ছ্বাস! সে বলল মা, ‘কী সুন্দর ফুল ফুটেছে, ওই দ্যাখো ঝর্ণা!’
দিনশেষের কমলা আলো আস্তে আস্তে খয়েরি রং ধরেছে।
আমাদের মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়াল একটা পাঁচিল ঘেরা একতলা বাড়ির সামনে। স্থানটা বেশ নির্জন। একটু দূরে দূরে বেশ কয়েকটা বাড়ি আছে অবশ্য।
এই বাড়িটা বেশ পুরনো। অনেকটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাংলোর আদলে। জানলাগুলো রঙিন কাঁচের। এই কাঁচের জানালা বেয়ে উঠেছে একটা বড় মাধবীলতা গাছ আর এক অপরাজিতা গাছ। বাড়ি জুড়ে মিষ্টি ফুলের গন্ধ। এই গাছের জন্যই বাড়িটা কেমন যেন দিনের বেলাতেও আলো-আঁধারিতে ঘেরা।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘নন্দিনী পছন্দ হয়েছে তো বাড়িটা? এখানে আমার নতুন স্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টারের বাড়ি এটা। এখন উনি স্কুল থেকে অবসর গ্রহণের পর শিলিগুড়িতে থাকেন। তাই আমাদের ভাড়া দিলেন। দারোয়ান রঘু দেখাশোনা করত এতদিন।’ বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হল।
তবে অনিমেষ যখন বাড়িতে থাকে না, কেমন যেন ভয় ভয় করে।
মাস দুয়েক হল এখানে এসেছি। আশপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গেও বেশ আলাপ পরিচয় হয়েছে। মিঠুকেও এখানকার স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলে, পাড়ায়, বেশ কয়েকজন কচিকাঁচা—ওরই মতন বন্ধু জুটেছে। বেশ কাটছে দিনগুলো।
সেদিন ছিল মিঠুর জন্মদিন, বাড়িতে একটা ছোটখাটো পার্টি দেওয়া হয়েছিল। সব আয়োজন অনিমেষ করেছিল। মিঠুর অনেক বন্ধু এসেছিল। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাল, নাচে গানে বেশ জমজমাট অনুষ্ঠান হল। সকলে চ’লে গেল।
রাত সাড়ে তখন বারোটা, কিন্তু মিঠুর চোখে ঘুম নেই। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গিফটের প্যাকেটগুলো খুলে দেখছিল।
হঠাৎ সে ‘মা! বাবা—’ বলে চিৎকার করে উঠল। আমরা তার কাছে গেলাম। সে বলল, ‘দেখো, একটা ভাই পেয়েছি!’ চেয়ে দেখি একটি সোয়েটার-পরা পুতুল। দেখতে অবিকল একটা মাস ছয়েকের ছোট্ট বাচ্চা ছেলের মতো। নীলার মতো উজ্জ্বল দুটি চোখ, মাথায় কোঁকড়ানো এক মাথা চুল, আর ফোকলা মুখে চেয়ে আছে।
কে বলবে যে এটা একটা পুতুল! চোখের মণি থেকে হাতের আঙুল— অবিকল একটা সত্যিকারের বিদেশি বাচ্চা ছেলের মত। মেয়ের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে অনিমেষ বলল, ‘সত্যি! পুতুলটা তো দারুন। নন্দিনী এটা তোমার সবু মাসি ইউএসএ থেকে পাঠিয়েছেন তাই না?’
হ্যাঁ, এটা তো সেই পুতুল। সবু মাসি আমার মাসতুতো ভাই রাজার হাত দিয়ে পাঠিয়েছেন পুতুলটা লস এঞ্জেলেস থেকে। আমি একটু পুতুলটাকে কোলে নিয়ে, পুতুলটার পেটে হালকা চাপ দিতেই হঠাৎ ‘হিহি হিহি হিহি’ বাচ্চার হাসির শব্দ। ও মা, পুতুলটা তো হাসছে! পুতুলটা যে শুধু হাসে তা নয়, হাসতে-হাসতে আবার মাথা ঘোরাতে পারে, হাত-পাও নাড়তে পারে। সত্যিই দারুণ!
দেখা গেল যে মিঠুর এই পুতুলটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। সব ফেলে সে এই পুতুলটা নিয়েই থাকে। তার জন্মদিনের পর থেকে এটাই হয়ে ওঠে ওর ‘পুতুল-ভাই’।
পুতুল ভাইকে নিয়ে সারাটা দিন কাটে মিঠুর। রাতে পুতুল ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। থেকে-থেকে পুতুলটার পেটে হাত দিলেই, পুতুলটা যখন হাসে, তখন মিঠুও মনের আনন্দে হাততালি দেয়। তবে ইদানীং আমার একটু সুবিধাই হয়েছে, মিঠুকে খাওয়াতে আর কষ্ট করতে হয় না। একটা থালায় ভাত মেখে একসঙ্গে পুতুল ভাইকে ও মিঠুকে খেতে দিয়ে শুধু বলতে হয়, ‘পুতুল ভাই ভালো না, ভালো করে খায় না, মিঠু কত ভালো।’ অমনি মিঠুর পাত পরিষ্কার, সবটি মুছে খেয়ে নেয়।
একদিন মিঠুকে পড়াচ্ছি, পাশে পুতুলটা আছে। আমি বললাম, ‘মিঠু কত সুন্দর এবিসিডি বলতে পারে, পুতুল ভাই পারে না . . .’ অমনি মিঠু গরগর করে এ থেকে জেড অব্দি বলে দিল। আমি চুমু খেয়ে বললাম, ‘গুড গার্ল।’
হঠাৎ পুতুলটার দিকে তাকিয়ে মনে হল ওর কেমন যেন চোখ ছলছল করছে। তবে কি পুতুলের অভিমান হয়? পরক্ষণেই মনে হল আমার-ই মনের ভুল। মাঝেমধ্যে পুতুলটার দিকে তাকালে মনে হয় ও যেন আমায় কত কিছু বলতে চায়, মনে হয় যেন ওর মধ্যে প্রাণ আছে। মিঠু পুতুলটাকে একদম নিজের ভাইয়ের মতই ভালোবেসে ফেলেছে।
অনিমেষকেও একদিন সে কথা বলেই ফেললাম। অনিমেষ হেসে বলল, ‘ওমা জানো না! . . . অনেক সময় পুতুলের মধ্যেও প্রাণ থাকে।’
আমি বললাম , ‘ধুর, কি যে বলো!’
অনিমেষ বেশ সিরিয়াসলি বলল, ‘অনেক আত্মা পুতুলের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। আমি নিজেও এই পুতুলটাকে চোখের পাতা ফেলতে দেখেছি একদিন।’
‘সব সময় আমায় নিয়ে মজা করো’— এই বলে ওর কথায় আমি বিশেষ পাত্তা না দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। তবে মনে একটু ভয় ভয় হতে লাগল।
একদিন সকালে মিঠু কিছুতেই দুধ খেতে চাইল না।
বায়না ধরল— ‘পুতুল ভাই যদি না খায় তবে আমিও খাব না’—
মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে একটা ছোট বোতলে একটু দুধ দিয়ে পুতুলটার সামনে রেখে দিলাম।
মিঠু যথারীতি দুধটা খেয়ে নিল।
আমি বললাম, ‘সত্যিই পুতুল ভাই খারাপ, সে তো দুধ খায় নি—’
মিঠু বলল, ‘না, পুতুল ভাই ভালো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, দেখো ও খেয়ে নেবে—’ এই বলে সে পুতুলের মুখে দুধের বোতলটা ধরে— ‘ভাই দুধ খাও, দুধ খাও, সোনা ছেলে’ . . . ইত্যাদি বলতে লাগল।
ওমা, খানিকবাদে এসে দেখি বোতলটা ফাঁকা। আমি বললাম, ‘এই বোতলের দুধ কে খেলো? মিঠু তুমি?’
মিঠু বলল, ‘না, ওটা তো ভাই খেয়েছে। আমি খাইয়ে দিলাম, ও খেয়ে নিল। আজ পুতুল ভাই গুড বয়, তাই না মা?’
হঠাৎ করে পুতুলটার দিকে তাকিয়ে মনে হল ও যেন হাসছে! কী জানি, সবই কি তবে আমার মনের ভুল! আমি যে একটু কল্পনাপ্রিয় সেটা আমি নিজেও জানি।
সেদিন রবিবার। রাত দশটা বাজে। মিঠু ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি রান্নাঘরে। হঠাৎ দেখি ড্রয়িংরুম থেকে টিভি চলার শব্দ আসছে। মিঠু কি তবে উঠে পড়ল? গিয়ে দেখি কেউ নেই সেখানে, টিভিতে ছোটা ভিম কার্টুন চলছে। সোফায় বসে পুতুলটা টিভির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ঠিক যেন খুব মন দিয়ে কার্টুন দেখছে।
মিঠু তো পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে, তবে টিভি চালাল কে? অনিমেষ তুমি?
অনিমেষ বলল, ‘আমি তো কখন থেকে বারান্দায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছি।’ তবে কে?
‘দেখো হয়তো পুতুলটাই . . .’ বলে অনিমেষ হাসতে লাগল। আমি রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলাম আবার।
রান্না ঘরের জানলা দিয়ে দেখি, আমাদের বাগানে টাঙানো নতুন দোলনায় পুতুলটা দুলছে নিজে নিজে। পাশে অনিমেষ কাজ করছে কিন্তু ওর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। কেমন যেন লাগে আজকাল আমার পুতুলটাকে।
কাল রাত থেকেই মিঠুর শরীরটা ভাল নেই। ভীষণ জ্বর। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি, পুতুলটার মুখটা যেন গোমড়া। মিঠুকে ভোলাবার জন্য পুতুলের পেটে কত চাপ দিলাম, আশ্চর্য! পুতুলটা হাসছে না, হাত পাও নাড়ছে না। অনিমেষ সন্ধ্যেবেলায় মিঠুকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গেল। আমি বাড়িতে একা। গতকাল রাত্রে ভালো করে ঘুম হয় নি। বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙল হাসির শব্দে।
ঘুম ভেঙে দেখি চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইট চলে গেছে ,বাইরে ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে। দমকা হাওয়াতে গাছগুলো যেন আছড়ে পড়ছে কাঁচের জানলায়।
কে হাসছে এত জোরে? এ তো পুতুলটার হাসির শব্দ!
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। পরিষ্কার দেখতে পেলাম পুতুলটা শোকেস-এর ওপরে। তবে কি ওটা হাসছে?
মাথা ঘোরাচ্ছে, হাত-পা নাড়ছে? কীভাবে? কেউ তো তাকে স্পর্শ করেনি!
আমি ছাড়া এই ঘরে আর কি কেউ আছে? তার হাসি আর থামছে না।
আবার বিদ্যুত চমকালো। মনে হল পুতুলটা নড়েচড়ে উঠল।
তবে কি পুতুলটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে? একটা অপার্থিব ভৌতিক পরিবেশে আমি একা। আমি চিৎকার করছি। কিন্তু এত বৃষ্টির শব্দে, দূরের বাড়িগুলো থেকে কেউ আমার ডাক শুনতে পাচ্ছে না। আর কিছু মনে নেই।
পরে যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি অনিমেষ আমার চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছে। বাড়িতে অনেক লোকজন। আমি সব ঘটনা বললাম। বললাম, ‘এক্ষুনি ফেলে দাও পুতুলটাকে, ওই পুতুলটা ভূত . . .’
কিন্তু মিঠু পুতুলটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, ফেলতে দেবে না কিছুতেই।
খানিকবাদে অনিমেষ আমার বিছানার চাদরের তলা থেকে একটা ছোট্ট মেশিন আবিষ্কার করল। আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এবার ওটাতে চাপ দাও তো!’
চাপ দিতেই দেখি, ওটা থেকে হাসির শব্দ আসছে। সেই পুতুলটার হাসির শব্দ।
হাত-পা নাড়ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে পুতুলটা। যেমন করে সব সময়, ঠিক তেমনি।
অনিমেষ তখন বলল, ‘আসলে মিঠুর খেলার সময় কখন যে পুতুলটার জামাটা ছিঁড়ে পুতুলের হাসির মেশিনটা আমাদের বিছানার চাদরের তলে খুলে পড়ে গেছে তা আমরা কেউ খেয়াল করিনি। অন্ধকার ঘরে তোমার হাতে চাপ লেগে সেখান থেকে হাসির শব্দ বেরোচ্ছিল . . . আর তাতেই একটা সামান্য পুতুল তোমার কাছে একটা জীবন্ত ভূত হয়ে উঠল!’
আমি বললাম, ‘তবে যে সেদিন দুধ খাওয়া, টিভি দেখা, দোলনায় দোলা, ওগুলো তবে কি?’
অনিমেষ তখন হেসে বলল, ‘ওগুলো তো আমি সব করেছি, তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য, তুমি যা ভীতু . . .’