বুচাই এবার ক্লাস সেভেনে উঠবে। বয়স কম হলে কি হবে, নেতা মন্ত্রীদের মত বুচাইকেও পাড়ায় সকলে একডাকে চেনে। কারণ, অমন ডানপিটে ছেলে শুধু এ পাড়ায় নয়, আশে পাশে আরো পাঁচটা পাড়া খুঁজলেও চট করে পাওয়া যাবে না। কারো গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ছে, কোনো এক ঠাকুমার রোদে দেওয়া আচারের বয়েম থেকে আচার নিয়ে পালাচ্ছে— এমন কীর্তিকলাপ ওর প্রায়ই কিছু না কিছু থাকেই। এসবের জন্য মায়ের কাছে কানমলা, গাঁট্টা একটু আধটু জোটে বটে, তবে তা গা সওয়া হয়ে গেছে।
বুচাইয়ের বন্ধু বান্ধবের একটা দল আছে। বলাই বাহুল্য বুচাই তাদের পান্ডা।
সেদিন স্কুল ছুটি, তাই বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি সকলে খেলার মাঠে জড় হয়েছে। খেলার বলটা কালকে ঝোপে কোথায় যে পড়ল, অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না। চাঁদা তুলে নতুন বল না কেনা পর্যন্ত খেলা বন্ধ।
তা বলে মাঠে আসা তো বন্ধ করা যায় না।
দৌড়োদৌড়ি, খুনসুটি করতে করতে বুচাই বলল, ‘বিলের ধারে যাবি?’
অজু একটু ভিতু প্রকৃতির, কিন্তু কিন্তু করে বলল— ‘সে তো অনেক দূর!’
বুচাই ধমকে বলল— ‘দূর তো কি হয়েছে, এখন গেলে সন্ধের আগে ফিরে আসব। ওখানে অনেক কুল গাছ আছে, কুল পেড়ে খাওয়া যাবে।’
বুলু জিজ্ঞেস করল— ‘তুই রাস্তা চিনিস?’
—বাবার সাথে একবার গিয়েছিলাম, ঠিক বার করে নেব।
নাড়ু বলল— ‘বিলের ধারে নাকি একটা পোড়া মন্দির আছে, শুনেছি জায়গাটা ভালো নয়।’
বুচাইয়ের অনেক অনুরোধেও নান্টা ছাড়া আর কেউ ওর এই অভিযানে সামিল হল না।
অগত্যা— ‘সব এক একটা ভিতুর ডিম, চল নান্টা আমরা দুজনেই যাই’—বলে বুচাই রওনা হল।
বেশ কিছুটা যাওয়ার পর, আশেপাশে কোনো বাড়িঘর বা লোকজন দেখা গেল না।
বুচাই বিলে যাওয়ার রাস্তা আর ঠাহর করে উঠতে পারছিল না। এমন কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করবে। বিষয়টা নান্টার কাছে ভালো ঠেকল না। সে বলল— ‘চল বুচাই, আর গিয়ে কাজ নেই, বাড়ি ফিরে যাই।’
বুচাই হেসে বলল— ‘তুইও ওদের মত ভয় পেয়ে গেলি। ঘাবড়াস না, আর একটু চল, রাস্তা ঠিক বার করে নেব—’
আরো কিছুটা এগোতেই দুজনেই লক্ষ্য করল দূরে লাল আলখাল্লার-পরা একজন লোক ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
নান্টা বলল— ‘বুচাই, ওই দেখ কাপালিক। আমাদের মত বাচ্চা দেখলে ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দেয়, শিগগিরি পালা।’
সন্ধে প্রায় হয় হয়। বুচাইও এবার ভয় পেয়ে গেল।
কাপালিকদের গল্প সেও শুনেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, চেষ্টা করেও ওরা পালাতে পারল না। ঊল্টে নিজের অজান্তেই একপা একপা করে ওরা সেই মানুষটার দিকে এগোতে থাকল।
নান্টা এবার কাঁদতে শুরু করল—‘বুচাই, এ কি হচ্ছে রে? তোর পাল্লায় পড়ে আজ নির্ঘাত বলি হয়ে গেলাম!’
বুচাইয়ের তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। ধীরে ধীরে ওরা পৌঁছে গেল লোকটার কাছে। ভয়ে তখন দুজনেই কাঁপছে। কোনোরকমে তাকিয়ে দেখে মুখে ইয়া বড় দাড়ি, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, মাথায় লাল পাগড়ি, লাল আলখাল্লা-পরা মাঝ-বয়সি লোকটা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ওদের অভয় দিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল— ‘কোথায় থাক বাছারা?’
নান্টা কোনরকমে ফিসফিস করে বলল— ‘নয়ন পল্লী’।
—সে তো বেশ দূর। বড়দের সঙ্গে না এসে এতদূরে এই নির্জন জায়গায় তোমাদের একলা আসা উচিত হয়নি। কত রকম বিপদ হতে পারত।
বুচাই ঘাবড়ে গিয়ে বলল— ‘কাকু, আমরা বাড়ি ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। সামনে বাঁশঝাড়, ভীষণ ভয় করছে। বুঝতে পারছি না, কী করে বাড়ি ফিরব’।
সাধুবাবা হেসে বলল— ‘ভয় পেওনা, সামনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাও। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি, ও তোমাদের পৌঁছে দেবে। এমন কাজ আর কখনো কোরো না’।
ওদের ভয় তখন অনেকটা কেটে গেছে।
সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই বুচাই দেখে টাক মাথা একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে ময়লা জামাকাপড়। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, কিন্তু মুখে কোন দাঁত দেখা যাচ্ছে না। তাকালেই কেমন ভয় হয়।
এগিয়ে এসে লোকটা শুধল— ‘খোকারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ তো! ঠাকুর মশাই বললেন তোমাদের বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে আসতে। কোনো চিন্তা নেই, তোমরা দুজনে আমার দুটো হাত ধরো!’
নিরুপায় হয়ে ওরা লোকটার হাত ধরেই চমকে উঠল। বরফের মত ঠান্ডা। ভয়ে কাঁটা হলেও মুখে কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল। কী আশ্চর্য, মুহূর্তে ওরা পৌঁছে গেল বাড়ির সামনের রাস্তায় আর সাথে সাথে পাশের লোকটাও উধাও।
বাড়ি ফিরতে পেরে মনে স্বস্তি পেলেও এতক্ষণের নানা ঘটনায় ওরা তখন বিস্ময়ে হতবাক।
একটু স্বাভাবিক হবার পর বুচাই বলল— ‘নান্টা, ওদের দুজনের কারোর কাছেই তো ফোন ছিল না, তাহলে কাপালিক অত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই লোকটাকে আমাদের পৌঁছে দেবার কথা কি করে বলল?’
—কাপালিকদের আলাদা ক্ষমতা থাকে। দেখলি না, আমাদের কেমন ওর কাছে টেনে নিয়ে গেল।
—আর নান্টা পরের লোকটা? ও তো কাপালিক নয়। ও কোন ক্ষমতায় এতটা রাস্তা এইটুকুনি সময়ে পার করে দিল। আর ওর হাতটা তো কনকনে ঠান্ডা ছিল। আজ জোর বেঁচে গেছি রে।
বাড়িতে ঢুকতেই মা জিজ্ঞেস করলেন— ‘কী রে বুচাই, এত দেরি হল কেন? আজ আবার কোন অনর্থ করে আসিস নি তো?
বিকেলের সমস্ত ঘটনা বুচাই মাকে বলল।
সব শুনে মা বললেন— ‘তুই ঠিক দেখেছিস?’
—হ্যাঁ মা।
ছেলেকে কাছে টেনে মাথায় ঠাকুরের নাম জপ করতে করতে বললেন— ‘উনি ওই পোড়া মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। তিন চার বছর আগে মারা গেছেন। আর ওই লোকটা ছিল ওনার চেলা, আশে পাশে কোথাও থাকত। ও আরো আগে মারা গেছে। ওঁদের অশরীরী আত্মা আজ তোদের বাঁচিয়েছে।
—মা ভূত তাহলে ভালোও হয়?
—মানুষ মারা গেলেই তো ভূত হয়। ভালো মানুষ ভালো ভূত হয়, মন্দ মানুষ মন্দ ভূত হয়। তবে দোহাই বাপ, মন্দ ভূত পরখ করতে আবার যেন নতুন কোনো কাণ্ড ঘটিও না।