Categories
রকমারিনগর |

গ্রাফোলজির সহজপাঠ

834 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সময়িতা বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রাফোলজিস্ট ও গ্রাফোথেরাপিস্ট

ছবি ও গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সালটা ২০০৭। সেন্ট্রাল কলকাতা অঞ্চলের এক গয়নার দোকান থেকে চুরি হয় একটা ৭০,০০০ হাজার টাকার সোনার নেকলেস। দোকানের মালিক অনেক বিবেচনা করে বুঝতে পারেন যে যখন কারখানা থেকে বেশ কিছু গয়না এসে শোরুমে পৌঁছায়, একমাত্র তখনই সেই চুরি হওয়া সম্ভব। সেই সময় দোকানে ছিল মোট ১১ জন কর্মচারী। কলকাতা পুলিশের হেড-কোয়াটার্স-এ নালিশ দায়ের করা হয়। পুলিশ এসে ওই ১১ জনকে এক এক করে জেরা করেন। কিন্তু করেও তারা নির্দিষ্ট কাউকে চিহ্নিত করতে পারেন না। হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে দোকানের মালিকের এক বিশেষজ্ঞের কথা মনে আসে। তিনি দ্বারস্থ হন এক ইনস্টিটিউটের। বিশেষজ্ঞ সব শুনে বলেন ‘আপনি ওই ১১জনকে একটা করে সাদা A-4 size কাগজে নিজেদের সম্পর্কে লিখতে বলুন। তারপর লিখুক, ঠিক যে সময় চুরি হচ্ছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন এবং কী করছিলেন। আর এটাও লিখতে বলুন যে এই চুরি সম্পর্ক তারা কিছু জানে কি না। এবং এই সম্পূর্ণ লেখাটার পর সই করতে বলুন।’

এই ভাবে ১১-টা হাতের লেখা সংগ্রহ করা হয়। লেখাগুলো ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ দেখেন যে একটা হাতের লেখায় কিছু অসংগতি দেখা যাচ্ছে। এই অসংগতিগুলো একটু বলা যাক। (১) লেখার সময় দুটো শব্দের মধ্যে কতটা ব্যবধান থাকবে ব্যপারটা এক-এক মানুষের এক-এক রকম হয়। এই ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল যে লেখকের যে স্বাভাবিক শব্দ-ব্যবধানের অভ্যাস সেটা ব্যাহত হয়েছে যখন তিনি লিখছেন যে তিনি চুরির সময় কোথায় ছিলেন এবং কী করছিলেন। এই লেখার সময় শব্দের মাঝের স্বাভাবিক ব্যবধান বেড়ে গেছে। এর থেকে বোঝা যায় যে তাকে ওই কথাগুলো সাজানোর জন্য একটু সময় নিতে হয়েছে। (২) তিনি চুরি সম্বন্ধে কিছু জানেন না এটা লেখার সময়েও তার লেখার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা বাধা পেয়েছে। (৩) লেখার বিষয়বস্তু থেকে তার সই অনেক দূরে সরে গেছে যা থেকে বোঝায় যে তিনি এই ঘটনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। এই ধরণের আরও কয়েকটি অসংগতির কথা নজরে এনে বিশেষজ্ঞ দোকানের মালিককে জানান যে তার সন্দেহ এই ব্যক্তির ওপর। দোকানের মালিক একটু দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান― হাতের লেখার ভিত্তিতে উনি একজনকে দোষী সাব্যস্ত করবেন কী করে। অবশেষে পুলিশ অফিসারদের একটু ইঙ্গিত দিতে তারা আরেকবার ওই লেখার লেখককে কড়া জেরার মধ্যে ফেলেন। তখন ওই ব্যক্তি তার নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং সোনার নেকলেসটা ফেরত দিয়ে দেন।

যে বিজ্ঞানের হাত ধরে এই রহস্যের উন্মোচন হল তারই নাম গ্রাফোলজি। গ্রাফোলজি শব্দটা এসেছে দুটো গ্রীক শব্দ থেকে, গ্রাফ ও ওলজি থেকে। গ্রাফ শব্দের অর্থ হল লেখা এবং ওলজি শব্দের অর্থ হল বিশ্লেষণ বা বিজ্ঞানচর্চা। এই দুই শব্দ মিলিয়ে গ্রাফোলজির বাংলা মানে দাঁড়ায় হাতের লেখার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। একটু বিস্তারিত ভাবে বলা যায় যে গ্রাফোলজি হল বিজ্ঞানের সেই ভাগ যার মাধ্যমে হাতের লেখার দ্বারা মানুষের চিন্তা ভাবনার গতিপথ, ব্যবহার-বুদ্ধি, মানসিকতা, এমনকি স্বাস্থ্যের লক্ষণ অবধি বোঝা যায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে হয় এই বিশ্লেষণ? এর পেছনের বিজ্ঞানটা কী? সেটা একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

মন এবং শরীর— এই দু’টি আলাদা আলাদা সত্তা― এই ভুলটা বিজ্ঞানীদের বহুদিন আগেই ঘুচে গেছে। যদি একটা সাধারণ ঘটনা দিয়েই ভাবি আমরা— ধরা যাক আমার খিদে পেয়েছে। এই যে আমি অনুভব করলাম যে আমার খিদে পেয়েছে, এই অনুভূতি এল কোথা থেকে? আমার পাকস্থলী যে খালি হয়েছে সেটা বিভিন্ন neurons বা nerve cell রিলে রেসের মতন খবর দিল আমার মস্তিষ্ককে। তখন আমি খিদে অনুভব করলাম। ঠিক এইভাবেই আমাদের শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা nerve বা neuron cells প্রতি মুহূর্তে এই পরিবেশ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে এবং ব্রেন বা মস্তিষ্ককে তা সরবরাহ করছে। একটি neuron থেকে অন্য neuron এই সমস্ত খবর পৌঁছায় একটি তড়িৎ—রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে। এই সকল রকম তথ্য আয়নের আকারে জমা থাকে।

এবার আমি আসি হাতের লেখার কথায়। আমাদের মস্তিষ্কে Motor Cortex বলে একটা জায়গা আছে। যখন আমরা লিখি তখন আঙুলে চাপ পড়ে। আর আঙুলের মাধ্যমে মস্তিষ্কের Motor Cortex-এ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এতে ব্রেনের ion de-code হয় এবং ionগুলো একটা তড়িৎ-রাসায়নিক স্পন্দন তৈরি করে। এই স্পন্দন আমাদের মস্তিষ্কে এবং Central nervous system থেকে Peripheral nervous system হয়ে পেশিতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং এইভাবে হাতের বিভিন্ন পেশি দিয়ে তৈরি হয়ে যায় লেখা। আসলে একেক-ধরণের অনুভূতি আমাদের Motor cortex-এ একেক-ধরণের movement সৃষ্টি করে। আর হাতের লেখায় এই movement গুলোকেই বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব গ্রাফোলজিস্টদের। তাই একটা হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে তারা ঝপ করে বুঝে ফেলেন মনের নানা দিক ও প্রবণতার কথা।

গ্রাফোলজিস্টরা কী কী দ্যাখেন হাতের লেখায়? লেখার মধ্যে কোন কোন বৈশিষ্ট্য কোন কোন আবেগের ছবি ফুটিয়ে তোলে— এই নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা পরের সংখ্যায়। আর ততদিন তোমরা কী করবে? তোমরা একটা সাদা A4 সাইজ কাগজে একটা বড় করে প্যারাগ্রাফ লিখে রাখতে পারো। পরের সংখ্যাটা পাবার সময় নিজেদের লেখার সাথে মিলিয়ে দেখা যাবে।