জীবনবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে আসার পর থেকে ভয়ে একদম সিঁটিয়ে আছে ঘন্টু। তার বুক ধড়ফড় করছে। মাঝে মাঝে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড রকম জল তেষ্টা পাচ্ছে। শরীরে অস্বাভাবিক ঘাম হচ্ছে। কারণ আগামীকাল তার মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা। ঘন্টু বরাবরই অঙ্কে কাঁচা। উপপাদ্য, সম্পাদ্য ত্রিকোণমিতি, পরিমিতির সব অঙ্ক তার মাথার উপর দিয়ে যায়। কখন কোন্ নল দিয়ে চৌবাচ্চার জল বেরোচ্ছে আর কোন নল দিয়ে চৌবাচ্চায় জল ঢুকছে আবার এর মধ্যে কখন চৌবাচ্চা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা। যদি চৌবাচ্চাটা ভর্তি করতেই হয় তাহলে নলটা খুলে রাখা হয়েছে কেন? নলটা বন্ধ করে দিলেই হয়।
এছাড়াও আছে বীজগণিতের প্লাস মাইনাসের অঙ্ক। বীজগণিতের সমীকরণগুলো সে সবসময় গুলিয়ে ফেলে। ঘন্টুর প্রশ্নের চোটে স্কুলের অঙ্কের স্যার শম্ভুবাবুর নাজেহাল অবস্থা। ঘন্টুর পিছনে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন— অনেক খেটেছেন কিন্তু শেষে হাল ছেড়ে স্বীকার করেছেন—‘বাবা ঘন্টু, তোর দ্বারা আর যাই হোক অঙ্কটা একদম হবে না। কোনোভাবে তুই যদি মাধ্যমিকে অঙ্কে পাস করিস তাহলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করব।’
স্কুলের পরীক্ষায় সে বরাবর অঙ্কে ভীষণ কম নাম্বার পেয়ে এসেছে।
এখন যত চিন্তা তার মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষাটা নিয়ে।
যদিও সে বছরের প্রথম থেকে প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে অঙ্ক প্র্যাকটিস করেছে, কিন্তু এখনও ঠিকমতো কনফিডেন্স পাচ্ছে না।
ঘন্টু যাতে অঙ্কতে পাস করতে পারে সেজন্য একজন অঙ্ক স্যারের পাশাপাশি পাশের বাড়ির অতনুর কাছে আরেকটা টিউশন দিয়েছেন ঘন্টুর বাবা।
ঘন্টুদের পাশের বাড়ির অতনু পড়াশোনায় ভীষণ ভালো।
মাধ্যমিকে উচ্চমাধ্যমিকে দুটোতেই অঙ্কে একশোর মধ্যে একশো পেয়ে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছে।
সে বর্তমানে মেদিনীপুর কলেজে অঙ্কে অনার্স করছে। প্রায় প্রত্যেক শনিবার রবিবার অতনু হোস্টেল থেকে গ্রামের বাড়িতে আসে।
আর এই শনিবার রবিবার দুদিন ঘন্টু অতনুদার কাছে অঙ্ক করে। অতনুদা খুব সহজ করে অঙ্কগুলো তাকে বুঝিয়ে দেয়। আর প্রচুর পরিমাণে উৎসাহ দেয়।
অতনুদার কথা শুনে মনে হয় সেও অঙ্কে পাস করতে পারবে। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে অতনুদাকে বারবার অনুরোধ করেছে ঘন্টু—
‘তুমি অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন আসবে অতনুদা। আমাকে শেষবারের মতো অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দেবে। তুমি এলে তবে আমার ভয় অনেকটা কাটবে।’
‘তুই একদম চিন্তা করিস না বাবু। পরীক্ষার আগেরদিন আমি ঠিক আসব।’
আগামীকাল অঙ্ক পরীক্ষা। কিন্তু আজ সকাল থেকে আবহাওয়া প্রচণ্ডরকম খারাপ।
একে শীতকাল তার উপর সারাদিন ধরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যার পর থেকে বাইরে আর কোনও জনপ্রাণী নেই। সবাই যে যার ঘরের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।
এই আবহাওয়া উপেক্ষা করে জেঠিমাদের বাড়িতে দুবার গিয়ে অতনুদার খোঁজ নিয়ে এসেছে ঘন্টু।
কিন্তু অতনুদা মেদিনীপুর থেকে বাড়ি আসেনি। ওর ফোনটাও বন্ধ। অতনুদার জন্য ভীষন মনখারাপ তার।
কিন্তু আবহাওয়ার ওপর তো কিছু করার নেই।
অগত্যা সারা সন্ধ্যা বসে বসে পুরানো অঙ্ক খাতাগুলো বের করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক উপপাদ্য মুখস্ত করে নেয় ঘন্টু।
তারপর মায়ের কথামত তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ঘরের জানালায় ঠকঠক শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে যায়।
‘—এই ঘন্টু—ঘুমিয়ে পড়েছিস্ না কি রে?’
ধড়ফড় করে বিছানার উপর উঠে বসে ঘন্টু। তাড়াতাড়ি জানালাটা খুলে দেখে জানালার ওপাশে অন্ধকারে একটা কালো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ঘন্টুর গলাটা কেঁপে যায়।
‘—ক-ক-কে?’
—এই ঘন্টু, দরজাটা খোল; আমি তোর অতনুদা। অঙ্ক করবি না?
—অতনুদা তুমি এত রাত্রে? তোমার তো বিকেলের ট্রেন আসার কথা ছিল।
—আর বলিস না ভাই, আজকে ট্রেনের অবরোধ ছিল। এই মাত্র বাড়ি এসে পৌঁছালাম। তুই তাড়াতাড়ি দরজাটা খোল। তোকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক দেখিয়ে দিই।
রাত জেগে পড়াশোনার জন্য ঘন্টু ওদের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরের শুয়েছিল। ওটাই ওর পড়ার ঘর। ওখানে অঙ্কের স্যার ইংরেজি স্যার বাংলা স্যার এসে ওকে টিউশন পড়িয়ে দিয়ে যায়। বৈঠকখানা ঘরটার বাইরের দিকে একটা আলাদা দরজা আছে। এই ঘরটা ওদের মূল ঘরের থেকে আলাদা। ঘন্টু সেই বাইরের দিকে দরজাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করে। আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে অতনু। চেয়ারে বসে বলে—
—ঠান্ডাটা আজ জব্বর পড়েছে। ঠান্ডায় হাত পা সব কনকন করছে। নে তাড়াতাড়ি অঙ্ক খাতাটা বের কর।
হ্যারিকেনের আলোটা উসকে দিয়ে বই খাতা নিয়ে বিছানায় উপর বসে পড়ে ঘন্টু। এদিকে ঝড় বৃষ্টির জন্য সন্ধ্যা থেকে আজ লোডশেডিং। হারিকেনের মৃদু আলোয় ঘরের মধ্যে একটা আলো ছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারপর চাদরে মুড়ে থাকার কারণে অতনুদার চোখ মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না ঘন্টু। তার কেমন যেন একটা অস্বস্তি আরম্ভ হয়। প্রচণ্ড শীত শীত করতে থাকে। চাদরের ভেতর থেকে অতনুদার গমগমে কণ্ঠস্বর তার কানে আসে।
—এই ঘন্টু, তিরিশের উপপাদ্যটা কর— লম্ব সমদ্বিখন্ডকত্রয় সমবিন্দু। এটা পরীক্ষায় এসে গেছে। আর আমি ত্রিকোণমিতির সাজেশচান করে দিচ্ছি। এই অঙ্কগুলো পরপর কষে যা। তোকে আমাকে অঙ্কে কোনোরকম ভাবে পঞ্চাশ পাওয়াতেই হবে। কাকুকে আমি কথা দিয়েছি। তোর জন্য আমি এই ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে মেদিনীপুর থেকে আসছি। আমার সম্মানটা ডোবাস নে ভাই। নে, পর পর যেমন বলছি সেভাবে অঙ্কগুলো কর।
এরপর ঘন্টা তিন-চার ঘন্টা ধরে অতনুদার কথামত অঙ্ক করে চলে ঘন্টু। তারপর সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। ঘন ঘন হাই ওঠে।
—কিরে ঘন্টু, ক্লান্ত হয়ে গেছিস ভাই? আজ তবে থাক। যে অঙ্কগুলো করিয়ে দিয়েছি আশা করছি এগুলোই তুই ঘুরেফিরে পরীক্ষায় পাবি। নে এবার ঘুমিয়ে পড়। আগামীকাল ঠান্ডা মাথায় অঙ্ক পরীক্ষা দিবি। একদম টেনশন করবি না। মনে রাখবি একটু চেষ্টা করলেই তুই সব অঙ্ক করতে পারবি।
ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় অতনু।
তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। গাঢ় অন্ধকারে চারপাশ কালো হয়ে আছে।
অতনুদা চলে যাবার পর ঘড়ির দিকে তাকায় ঘন্টু। রাত্রি তিনটে দশ বাজছে।
এতক্ষণ সে অঙ্ক কষেছে!
পরদিন পরীক্ষা হলে গিয়ে সে ভীষণ অবাক হয়ে যায়।
যে অঙ্কগুলো আগের রাতে অতনুদা করিয়েছে পরীক্ষার পেপারে ঠিক সেই অঙ্কগুলোই এসেছে। আর উপপাদ্য তো ওই তিরিশেরটা এসেছে।
খুশি মানে সে অঙ্কগুলো চটপট করতে আরম্ভ করে। আর কী আশ্চর্য কান্ড! প্রতিটা অঙ্ক একদম হুবহু স্টেপ বাই স্টেপ মনে পড়ে যাচ্ছে তার।
অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে হলের বাইরে বেরিয়ে বাবার শুকনো মুখটা দেখে আনন্দে হেসে ফেলে ঘন্টু। ইশ! তার জন্য টেনশনে বাবার মুখটা এমন শুকনো।
অতি উৎসাহে বাবাকে সে দুহাতে জড়িয়ে ধরে।
—একদম চিন্তা করো না বাবা। অঙ্ক পরীক্ষা আমার খুব ভালো হয়েছে। আমি অঙ্কে লেটার মার্কস পাব।
একটা অঙ্কও ভুল করিনি। একটা অঙ্কও ছাড়িনি। জানো বাবা আগের দিন রাত্রে অতনুদা যে অঙ্কগুলো দেখিয়ে দিয়েছে ঠিক সেই অঙ্কগুলোই পেপারে এসেছে।
ঘন্টুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকান ঘন্টুর বাবা।
—কী আবোলতাবোল বকছিস? গতকাল রাতে অতনু কখন এসেছিল?
—আরে তোমরা সব ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। আমাকে সারারাত ধরে অঙ্ক কষিয়েছে। তোমাকে নাকি কথা দিয়েছে আমাকে অঙ্কে পঞ্চাশ পাওয়াবে। সেজন্য ট্রেন অবরোধ সত্ত্বেও মেদিনীপুর থেকে চলে এসেছে।
ছেলের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় ঘন্টুর বাবা বলেন—
—চল, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল!
বাবার ব্যবহার দেখে ঘন্টু অবাক হয়ে যায়। সে এত ভালো পরীক্ষা দিয়েছে তবুও তার বাবা খুশি নয়। অন্য দিনের মতো ডাবের জল, দই মিষ্টি না খাইয়ে সোজা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। অভিমানে চুপ ক’রে বাবার মোটরবাইকের পিছনে বসে গ্রামে ফেরে ঘন্টু। ঘরে ফিরেও ঘরের পরিবেশ দেখে সে চমকে যায়। সবাইকার মুখ থমথমে। কারোর মুখে হাসি নেই। সে যে এত ভালো অঙ্ক পরীক্ষা দিয়েছে, সেটা শুনেও তার দাদু-ঠাকুমা-মা কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। সে কিছুক্ষণ বৈঠকখানাতে গোঁ হয়ে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ তীব্র কান্নার শব্দে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। কান্নাটা অতনুদার বাড়ি থেকে আসছে না? দৌড়ে সে অতনুদার বাড়িতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে মেঝেতে অতনুদাকে শোয়ানো আছে। একটা সাদা চাদরে দাদার শরীরটা ঢাকা। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। অতনুদার দু’চোখ বন্ধ। গলায় মোটা রজনীগন্ধার মালা পরানো। জেঠিমা জেঠু অতনুদাকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ডরকম কাঁদছে। তাদের বাড়ির সবাই এখানে আছে। হঠাৎ গলাটা শুকিয়ে যায় ঘন্টুর। সে জিজ্ঞেস করে— ‘কী হয়েছে! অতনুদা ও-ওভাবে শুয়ে আছে কেন?’
‘তোর অতনুদা আর নেই রে ঘন্টু। সে আমাদের ছেড়ে এজন্মের মত চলে গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় ট্রেন অ্যক্সিডেন্টে অতনু মারা গেছে’— কাঁদতে কাঁদতে ঘন্টুর মা বলে। মায়ের দিকে তীব্রভাবে তাকায় ঘন্টু।
‘কী যা তা কথা বলছ! গতকাল সারারাত অতনুদা আমাদের বাড়িতে ছিল। আমাকে অঙ্ক করিয়েছে। আমি নিজে রাত তিনটে দশ পর্যন্ত অতনুদার কাছে অঙ্ক করেছি। ভুলভাল বকছ কেন?’ ঘন্টুর চিৎকারে সবাই চমকে যায়। ঘন্টুর বাবা এসে ঘন্টুর হাত ধরেন—‘বাবা ঘন্টু চল ঘরে চল।’
‘অতনু আর কখনও তোকে অঙ্ক করাতে আসবে না রে ঘন্টু। আগের শনিবার ছেলেটা এসেছিল। আর এই সোমবার ছেলেটার মৃতদেহ ঘরে এল। আমি কি নিয়ে বাঁচব গো?’ গগনবিদারী চিৎকার করে কেঁদে ওঠে অতনুর মা।
ওখানকার আলোচনা থেকে ঘন্টু জানতে পারে গতকাল মেদিনীপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরার জন্য উল্টোদিকের রেললাইন টপকে ট্রেনে ওঠার মুহূর্তে একটা দুরপাল্লার মেইল ট্রেন অতনুদাকে ধাক্কা দেয়। অতনুদার কানে হেডফোন গোঁজা ছিল বলে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায়নি। রেললাইনেই স্পট ডেড। গতকাল সন্ধে থেকে বডিটা মেদিনীপুর হাসপাতালের মর্গে ছিল। আজ পোস্টমর্টেমের পর গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। সব শুনে সেখানেই গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে যায় ঘন্টু।
ঘন্টুকে ওখান থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে ওর বাবা-মা। জ্ঞান ফেরার পর প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে ঘন্টু। সে বলে, ‘বাবা, বিশ্বাস করো গতকাল রাত তিনটে পর্যন্ত অতনুদা আমাদের ঘরে ছিল। আমাকে অঙ্ক করিয়েছে। আমি মিথ্যে বলছি না—’
এসব শুনে ঘন্টুর ঠাকুমা বলেন—‘তোমাকে অতনু খুব ভালবাসত দাদুভাই। তাই তোমার জন্যই অতনুর আত্মা এই বাড়িতে এসেছিল।’
সব শুনেও ঘন্টুর কেমন যেন বিশ্বাস হয় না।
গতকাল রাত্রে অতনুদা আসেনি, অতনুদার প্রেতাত্মা তাকে অঙ্ক কষিয়ে গেছে!
কিন্তু সে তো অতনুদাকে প্রত্যক্ষ করেছে। অতনুদার গলা শুনেছে। শুধু মুখটা দেখতে পায়নি।
সেই রাতের কথা ভেবে এখনও আতঙ্কে শিউরে উঠে ঘন্টু।