Categories
খেলার মাঠ |

ভারতীয় ফুটবলের আশ্চর্যপ্রদীপ

1066 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া-উৎসাহী

চিত্র সৌজন্য: pkbanerjee.com; ABP Archive; গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

ভারতীয় ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, যাকে ময়দানের ঘাস চেনে পিকে ব্যানার্জি নামে। যাঁর বিদ্যুৎগতির ফুটবল বিপক্ষ শিবিরকে ছারখার করে দিত; যাঁর ‘ভোকাল টনিক’ শ্রবণে উদ্বুদ্ধ হত তাঁর ছাত্ররা; সেই কিংবদন্তি জাতীয় ফুটবলার এবং কোচ দীর্ঘ রোগভোগের পর ৮৩ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ২০ মার্চ ২০২০, শুক্রবার দুপুর দুটোর কাছাকাছি। শেষ হল এক বর্ণময় ফুটবল ব্যক্তিত্বের বিদ্যুৎগতির দৌড়।

জন্ম জলপাইগুড়ি জেলায় ২৩ জুন ১৯৩৬ সালে। ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ ছিল, তাই সব ছেড়ে সেটাকেই করেছিলেন জীবনের আদর্শ। মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে বিহারের হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেন তিনি, যে ম্যাচ হয়েছিল কলকাতাতে। সেই প্রথম তাঁর এই শহরে আসা এবং দর্শকের হৃদয় জেতা। এক চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলে সবার নজরে পড়েন প্রতিশ্রুতিমান পিকে। তাঁর পরিবারকে প্রবল আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। লড়তে হয়েছে থমকে যাওয়া সময়ের সাথে। তবু তিনি এগিয়ে চলেছিলেন আর পাশে পেয়েছিলেন তাঁর বাবাকে; যিনি তাঁকে বারবার পথ দেখিয়েছিলেন ধ্রুবতারার মত। সন্তোষ ট্রফি খেলার সুযোগ হবার আগে তিনি সদ্য একটি চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে খেলার জন্য ছুটির চেয়ে পাননি। এক দিকে চাকরি, অর্থের প্রয়োজন, অন্য দিকে খেলা। যেকোনও একটা তাঁকে বাছতেই হত। সেই সময়, তাঁর বাবা ছেলের জন্য পদত্যাগপত্র লিখে দিয়েছিলেন যাতে শুধু সই করেছিলেন মধ্য-কৈশোরের পিকে। তাঁর বাবা তাঁর সন্তানকে এগিয়ে দিয়েছিলেন অসংখ্য হৃদয় জয় করার উদ্দেশে।

এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৫ বছরে সন্তোষ ট্রফি, ১৯ বছরে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর তারপর মাত্র ২০ বছর বয়সে অলিম্পিকে সুযোগ। এ যেন এক স্বপ্নের সফর। ১৯৫৫-তে কলকাতার রাজস্থান ক্লাব আর তাঁর ঠিক পরের বছর ইস্টার্ন রেলের হয়ে খেলেন। টানা ১৪ বছর (১৯৫৫–১৯৬৮) ইস্টার্ন রেলের হয়ে কলকাতা লিগে ১১১ টা গোল করেন এবং ১৯৫৮-তে নিজের দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। বাংলার হয়ে ১৯৫৫-তে সন্তোষ ট্রফি জেতেন এবং এই সালেই ঢাকায় চারদেশীয় প্রতিযোগিতায় দেশের জার্সিতে আত্মপ্রকাশ এবং ওই প্রতিযোগিতায় ৫ গোল। এরপরের বছর ১৯৫৬-তে ছিল মেলবোর্ন অলিম্পিক্স, যে অলিম্পিক্সে ভারত চতুর্থ হয়। এই দলেও ছিল পিকে এবং তাঁর এটাই প্রথম অলিম্পিক্স। ঠিক তার চার বছর পর, ১৯৬০-এ আরও একটি পালক তাঁর মুকুটে যোগ হল— এবার তিনি ভারতীয় অলিম্পিক দলের অধিনায়ক। দেশের সেরাদের নিয়ে অলিম্পিক অভিযানের নেতৃত্বে তিনি। এই ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক্সে পিকে প্রথম ফুটবলার যিনি তিন প্রধান ক্লাবের বাইরে থেকে আসা ভারত-অধিনায়ক। এ এক ঈর্ষণীয় কৃতিত্ব। ঠিক তাঁর দু’বছর পর জাকার্তায় অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান গেমস। এই এশিয়ান গেমসে ভারত সোনা জেতে আর সেই ফাইনাল ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে তারা হারায়। এই ম্যাচে প্রথম গোলটি করেন পিকে এবং মোট ৪টি গোল করেন গোটা টুর্নামেন্টে। তাঁর কেরিয়ারে তিনি ৩টি এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেন; এবং এই তিনটি টুর্নামেন্টে তাঁর দেওয়া গোল-সংখ্যা ছিল মোট ৬টি।

তাঁর নতুন এবং আরও বর্ণময় অধ্যায়ের শুরু ১৯৬৭-তে। এই সালেই উনি অবসর নেন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আর পদার্পণ করেন কোচ পিকে হয়ে। সত্তরের দশক ছিল পিকে-র কোচিংয়ের সেরা দশক। ‘পিকে যেখানে, ট্রফি সেখানে’ এই ছিল সত্তরের দশকের প্রবাদ। একাধিক কোচিং কোর্স করে তিনি হয়ে উঠলেন ভারতের সর্বকালের সেরা কোচ। তাঁর তীক্ষ্ণ ‘গেম রিডিং’-এর ক্ষমতা এবং প্র্যাক্টিক্যাল সেন্স তাঁকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য কোচ। ইস্টবেঙ্গলকে ২৮টা ও মোহনবাগানকে ২৫টা; মোট ৫৩টা ট্রফি উনি এনে দিয়েছিলেন। এ এক বিরল রেকর্ড। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ১৯৭৩-য় উত্তর কোরিয়ার ডক রো গ্যাং-কে হারিয়ে ডিসিএম জয়; মোহনবাগানের হয়ে ১৯৭৮-য় আই. এফ. এ শিল্ড ফাইনালে রাশিয়ার বিখ্যাত দল আরারাতের সাথে ২-২ গোলে ড্র-করা ম্যাচগুলো তাঁর কোচিং কেরিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ম্যাচ।

১৯৭৬ সালে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানের কোচ হন পিকে; আর তাঁর পরের বছর ১৯৭৭-এ ফুটবল সম্রাট পেলে আসেন তাঁর দল কসমস নিয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে। কাঠের গ্যালারি দিয়ে সাজানো ইডেন গার্ডেন্সে ছিল সেই ম্যাচ। পেলেকে দেখার জন্য বিপুল আকর্ষণ আর উত্তেজনা ছিল শহর জুড়ে। মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য আর কোচ পিকে। তাঁর বিখ্যাত ভোকাল টনিকের জন্য উজ্জীবিত হয়েছিল তাঁর ছাত্ররা। সুব্রত এক জায়গায় বলেছেন ‘বিপক্ষে পেলে থাকলেও তা নিয়ে ভাববে না। মাথায় রাখবে ওরা তোমার প্রতিপক্ষ। পেলেকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।’ যদিও সেই ম্যাচ কসমস জেতে, কিন্তু মোহনবাগান খেলেছিল ভয়ডরহীন ফুটবল।

পিকে-র কথা বলতে গেলে আরও এক কিংবদন্তি ফুটবল কোচের কথা বলতে হয়— তিনি হলেন অমল দত্ত। তাঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল এক অন্য-মাত্রার। পিকে যখন ফুটবলার হিসেবে দুই প্রধান দলে উপেক্ষিত তখন তাঁর জীবনে সূর্যোদয় হয়ে পদার্পণ করলেন অমল দত্ত। ধর্মতলার রাস্তায় দাঁড়িয়ে কৈশোরের পিকে যখন কাঁদছেন, তখন অমল এসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বোঝান কী করে ময়দানের প্রতিকূল অবস্থায় লড়তে হয়; কিন্তু, তাঁরা ছিলেন ময়দানের দুই যুযুধান কোচ। একে অপরের বিরুদ্ধে বহু ম্যাচে কোচিং করিয়েছেন, তবে কোচিং কেরিয়ারের যুদ্ধ চরমে ওঠে ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে। অমল দত্ত তখন মোহনবাগানের কোচ আর পিকে ইস্টবেঙ্গলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। অমল দত্ত ভারতীয় ফুটবলে নিয়ে এসেছেন ‘ডায়মন্ড সিস্টেম’ যা কিনা সেই সময় ছিল বিপক্ষ সব দলের ত্রাস। ম্যাচ প্রস্তুতিপর্বে ইস্টবেঙ্গল দলে থাকা ভাইচুংকে অমল দত্ত নাম দিলেন ‘চুং চুং’, ওমোলো কে ‘ওমলেট’ আর সোসো কে ‘শসা’। যুবভারতীতে ম্যাচ শুরুর আগে ইস্টবেঙ্গল শিবির ছিল বেশ চাপে এবং ড্রেসিংরুম ছিল থমথমে। পিকে তাঁর দলের খেলোয়াড়দের বলেছিলেন ‘এই কয়েকদিন অনেক বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে তোমাদের। এই ম্যাচটায় জবাব দেবার শেষ সুযোগ।’ কাজে এসে গেল তাঁর বিখ্যাত ‘ভোকাল টনিক’। ভাইচুং এবং তাঁর দল উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই ম্যাচে মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে হারায় এবং জবাব দেয় সকল কটাক্ষের। অমল দত্তের ‘ডায়মন্ড সিস্টেম’ থেমে যায় পিকে-র ‘ভোকাল টনিক’-এর কাছে। এই দু’জন ফুটবল-চাণক্যের মধ্যে ছিল তীব্র প্রফেশনালিজম, অগাধ বন্ধুত্ব ও একে অপরের প্রতি স্নেহ এবং সম্মান।

পিকে ছিলেন কমপ্লিট ফুটবলার। তাঁর গতি, গোল করার মত শক্তিশালী শট, গোলের সামনে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা, নিখুঁত নিশানায় হেডিং-এর দক্ষতা তাঁকে করে তুলেছিল কিংবদন্তি। পিকে অনর্গল কথা বলতে পারতেন, আড্ডা দিতে ভালবাসতেন, সাহিত্য ও শিল্প চর্চার প্রতি ছিল অগাধ জ্ঞান এবং তিনি ছিলেন খাদ্যরসিক মানুষ। ১৯৬২-র জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী আর সেই দলেই ছিলেন পিকে। তৈরি হয়েছিল চুনী-পিকে-বলরামের ত্রিফলা আক্রমণ যা কিনা ছিল বিপরীত শিবিরের ত্রাস। পিকে-চুনী দু’জনেই চলে গেলেন। কিছু বছর আগে চলে গেলেন অমল দত্ত। ভারতীয় ফুটবলে ঘটে চলেছে নক্ষত্রপতন। সব যাওয়া তো আর যাওয়া নয়; তাঁদের অতুল কীর্তি অমর হয়ে থেকে যাবে ভারতের খেলার আকাশে। প্রদীপ নিভে গেলেও পিকে-র আশ্চর্য এবং উজ্জ্বল উপস্থিতি আগামী বহু প্রজন্মকে রোমাঞ্চিত করবে। তাঁর ‘ভোকাল টনিক’-এর কাহিনি উদ্বুদ্ধ করবে খেলার মাঠে দেশের হয়ে সেরাটুকু দেওয়ার জন্য ।