Categories
খেলার মাঠ |

ক্রিকেটের নিয়ম, নিয়মে ক্রিকেট

1117 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া-উৎসাহী

চিত্র সৌজন্য: freeimages.co.uk

রান-আপে বোলার হেঁটে যাচ্ছে আর মিড-অনে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার নিজের প্যান্টের সামনে জোরে জোরে নতুন ক্রিকেট বল ঘষে যাচ্ছে আর একটু করে থুতু আর মাঝে মাঝে ঘাম লাগিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই বলের পালিশ চকচকে রেখে আসছে ফিল্ডাররা ক্রিকেটের আদি সময় থেকে। শুধু ফিল্ডাররাই নয়, বোলাররাও ঘাম এবং থুতুর ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে, বলের একদিকের ওজন বাড়িয়ে নেবার জন্য যাতে সুইং পেতে সুবিধা হয়। বলের ধার বাড়ানোর জন্য শুধু এই পদ্ধতিতে বোলার বা ফিল্ডাররা থেমে থাকেনি, তারা নিজেদের সুবিধার্থে কখনও শিরীষ কাগজ অথবা ভেসলিন ব্যবহার করেছে যা কিনা আইন-বিরুদ্ধ। বারবার আমরা দেখেছি পাকিস্তান, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয় বোলাররা এইসব কাণ্ড ঘটিয়ে শাস্তিস্বরূপ ম্যাচ থেকে অপসারিত হয়েছেন।

কিন্তু সময়ের এমনই ফের যে, ক্রিকেট বলের সুইং ধরে রাখার জন্য হয়তো বা কোনও কৃত্রিম পদার্থ ব্যবহার করতে পারে বোলার বা ফিল্ডাররা যদি সেটা আইসিসি স্বীকৃতি দেয়। তারই সাথে সাথে উইকেট পাবার পর বোলার এবং ফিল্ডারদের উচ্ছ্বাসের ধরনও বদলে যেতে পারে। থেমে যেতে পারে হাই-ফাইভ, জড়িয়ে-ধরা এবং কাঁধে-চড়ার দৃশ্যগুলো। এই সব কিছুর পিছনে একটাই কারণ: কোভিড-১৯। এই অতিমারি পৃথিবী ও মানবজীবনের সহজ আর স্বাভাবিক চলনে আনতে চলেছে এক বিপুল পরিবর্তন। এমন এক পরিবর্তন যা বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীকে দুটি যুগে ভাগ করবে: একটি কোভিড-১৯-এর আগের যুগ এবং আরেকটি কোভিড-১৯-এর পরের যুগ। এই পরিবর্তনের প্রভাব বিপুলভাবে পড়বে খেলার দুনিয়াতেও, এমনকী ক্রিকেট মাঠেও।

এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব ক্রিকেট বলের তৈরি এবং সুইংয়ের ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে যদি ঘাম এবং থুতুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়। তারই সাথে সাথে উল্লেখ করব করোনার পর ক্রিকেট মাঠে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে আইসিসি-র নিয়ম অনুসারে। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক একটি ক্রিকেট বল কীভাবে তৈরি হয়। একটি ক্রিকেট বলের ভিতরে একটি শক্ত কর্ক থাকে আর বাইরে থাকে অর্ধগোলাকৃতি উচ্চমানের চামড়া— যে দুটি জোড়া দেওয়া হয় সেলাইয়ের মাধ্যমে। বলের ওজন হয়ে থাকে ৫.৫-৫.৭ আউন্স (১৫৫-১৬৩ গ্রাম)। বলের চকচকে ভাব ধরে রাখার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেট হোক কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট— সবক্ষেত্রেই ঘাম এবং থুতুর ব্যবহার করে আসছেন ফাস্ট বোলাররা। ইন সুইং, আউট সুইং কিংবা রিভার্স সুইংয়ের ক্ষেত্রে বলের একদিকের পালিশ ধরে রাখা খুবই জরুরি। তবে করোনার মত অতিমারির পর সামাজিক দূরত্বের সঙ্গে অন্যের হাঁচি, কাশি, সর্দি, থুতু এবং লালার সংস্পর্শে আসা একেবারেই নিষিদ্ধ এবং বিপজ্জনক। তাই বলের পালিশ ধরে রাখার জন্য কোনও কৃত্রিম উপায়— যেমন ভেসলিন হয়তো বা আসতে পারে, এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ওপর মহল থেকে। এটাও শোনা যাচ্ছে যে অস্ট্রেলিয়ার এক বল-প্রস্তুতকারক মোম গলিয়ে পালিশ করার কৃত্রিম পদার্থ তৈরি করেছে, তবে সেটা স্বীকৃতি পাবে কিনা এখনও বলা যাচ্ছে না। বলের পালিশটা ধরে রাখতে না পারলে কোনও সুইং-ই কাজ করবে না। দেখা যাবে না বিহাইন্ড-দ্য-উইকেট, স্লিপ, গালি, সিলি পয়েন্ট কিংবা শর্ট মিড উইকেটে দুর্ধর্ষ সব ক্যাচ। এইসব দৃশ্য দেখার জন্যই মাঠে যাওয়া আর সময় ব্যয় করে টিভির পর্দার সামনে বসে থাকা।

করোনা-পরবর্তী সময়ে ক্রিকেটে আরও যে সব পরিবর্তন আসতে চলেছে সেগুলো এবার জেনে নেওয়া যাক। প্রথমেই বলতে হয় ম্যাচের ১৪ দিন আগে কোভিড টেস্ট করা হবে গোটা দলের। এমনকী যতদিন দল একসাথে থাকবে, ততদিন খেলার পরেও শারীরিক পরীক্ষা চলবে। দ্বিতীয়ত, কিট ব্যাগে স্যানিটাইজার রাখতে হবে। খেলা চলাকালীন কেউ কারোর জিনিস ব্যবহার করতে পারবে না। তৃতীয়ত, ১.৫ মিটারের দূরত্ববিধি বজায় রাখতে হবে। যতটা সম্ভব ছোঁয়াছুঁয়ি এড়াতে হবে। এবার থেকে ছোট ছোট দলে প্র্যাকটিস করতে হবে। চতুর্থত, আম্পায়ারের হাতে টুপি এমনকি চশমা কোনও কিছুই ধরতে দেওয়া যাবে না। বোলারদের বল করার আগে নিজেদের এইসব সামগ্রী বাউন্ডারি লাইনের বাইরে রেখে এসে বল করতে হবে। পঞ্চম বিষয়টি হল, এবার থেকে প্রত্যেক দলে থাকবে একজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যিনি নিয়মিত দলের সবাইকে পরীক্ষা করবেন এবং পরামর্শ দেবেন। ষষ্ঠ বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ, আম্পায়ারদের সাদা কোটের সাথে হাতে পরতে হবে সাদা গ্লাভস। তাঁরাও যাতে কোনওরকম বিপদের সম্মুখীন না হন তাই এই সুরক্ষার ভাবনা।

এই এত কিছু পরিবর্তন নিয়ে কী করে করোনা-পরবর্তী যুগে ক্রিকেট চলবে তা নিয়ে থেকে যাচ্ছে বিস্তর প্রশ্ন। যেখানে বলা হচ্ছে দূরত্ববিধির কথা সেখানে প্রশ্ন হল স্লিপ কর্ডনের ক্ষেত্রে কী হবে? স্লিপ ফিল্ডারদের তো আর ওইভাবে দূরত্ব মেনে সাজানো যায় না! একটি দল খেলার আগে এবং পরে ১৪ দিন নিভৃতবাসে থাকার পর যদি শেষ দিনে কারোর কোভিড-১৯ ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে কি ওই খেলোয়াড় নাকি গোটা দলকে বাদ দেওয়া হবে? বল সুইংয়ের ক্ষেত্রেই বা কী হবে যদি লালা, থুতু বা ঘামের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়? সেক্ষেত্রে কৃত্রিম পদ্ধতিতে কি বল পালিশ করা চলবে, যেটা এখনও পর্যন্ত আইন-বিরুদ্ধ? এই এত কিছু পেরিয়ে, এত সব বদল নিয়ে ক্রিকেটের সেই আগের জৌলুস, উত্তেজনা আর আকর্ষণ কি ফেরত পাওয়া যাবে? এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাক্তন এবং বর্তমান সকল ক্রিকেটারদের মনে।

ধরে নেওয়া যাক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই সকল পরিবর্তন মেনে খেলা চলল। কিন্তু রাজ্যস্তরের ক্রিকেটে? জেলাস্তরের ক্রিকেটে? ক্লাব ক্রিকেটে? প্রশ্নগুলো থেকে গেলোই, উত্তর দেবে সময়। দর্শকশূন্য মাঠে ক্রিকেট খেলার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এটা ভাবতেই অবাক লাগে ইডেন গার্ডেনস, লর্ডস, মেলবোর্ন কিংবা বার্বাডোসের মাঠে দর্শক নেই অথচ ম্যাচ চলছে। যেসব পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো কি আগামী টি-২০ বিশ্বকাপ মাথায় রেখে নাকি বরাবরের জন্য? সেটাও পরিষ্কার নয়। ক্রিকেট মানে বিশ্বকাপ জয়ের পর ওয়াঙ্কেডেতে সতীর্থদের কাঁধে শচিনের মাঠ প্রদক্ষিণ, এক ইনিংসে ১০টা উইকেট নিয়ে কুম্বলের বলে চুম্বন কিংবা সেঞ্চুরি করে বিরাট কোহলির আলিঙ্গন রোহিত শর্মাকে। এতদিন ছিল নিয়ম মেনে খেলা উপভোগ করা এবং আনন্দ দেওয়া। এখন নিয়ম বলতে বিধিনিষেধ আর মেপে চলা— যা ক্রিকেট এবং যে কোনও খেলার পরিপন্থী। খেলা মানে তো মুক্ত বাতাস, বাউন্ডারিতে বন্দি নিষেধাজ্ঞা নয়। ক্রিকেট মানে লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ জয়ের পর কপিলের প্রুডেনশিয়াল কাপে চুম্বন আর দাদার বেপরোয়া টি-শার্ট ওড়ানো।

এক ব্যতিক্রমী সময়ের মুখোমুখি আমরা। সময়ই ঠিক করুক খেলাটা স্ট্রেট ব্যাটে হবে কিনা ।