বিশ্বের সর্বকালের সেরা কয়েকজন শিল্পীর নাম ভাবতে হলে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নাম মাথায় আসবেই, এবং বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবির কথা বলতে হলে ‘মোনা লিসা’-র কথা বলতেই হয়। লিওনার্দো জন্মেছিলেন ১৫ এপ্রিল ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর কাছে ভিঞ্চি শহরে। জন্মস্থান ও জন্মকাল দুটোই তাঁর জীবনে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
ছোটবেলায় কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী স্কুলে তাঁর প্রথাগত পড়াশোনা হয় নি। অনেকে মনে করেন, তার কারণ তিনি ছিলেন তাঁর বাবার বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান। একদম শিশুকালটি তাঁর মায়ের কাছে কেটেছে। তাঁর মা ক্যাটেরিনা সম্পর্কে বিশেষ জানা যায় না। তবে বাবা সের পিয়েরো ছিলেন ফ্লোরেন্সের নামী এবং সম্পন্ন ব্যক্তি। লিওনার্দো একটু বড় হলে, এবং সম্ভবত তাঁর বাবার আর কোন সন্তান তখনও না থাকায়, তিনি লিওনার্দোকে নিজের কাছে এনে মানুষ করেন। লিওনার্দোর পড়াশোনা বাড়িতেই হয় (সম্ভবত), যদিও আমরা দেখব বিবিধ বিষয়ে তাঁর অগাধ কৌতূহল ও জ্ঞান ছিল। কিন্তু তৎকালীন ইতালির শিক্ষিত লোকেদের লেখ্য ভাষা লাতিন তাঁর শেখা হয়ে ওঠেনি (অন্তত চল্লিশ বছর বয়স অবধি)। তাই ফ্লোরেন্সের পণ্ডিতকুলে জ্ঞানী হিসাবে তিনি মর্যাদা পাননি। অবশ্য অল্প বয়সেই তাঁর আঁকার ক্ষমতা সকলের নজরে পড়ে এবং তাঁর বাবা ফ্লোরেন্সের তথা ইতালির তৎকালীন বিখ্যাত ভাস্কর (sculptor) আন্দ্রিয়া ডেল ভেরাচিওর কাছে (সম্ভবত) বারো বছর বয়সে শিল্প শিক্ষার জন্যে পাঠান। কুড়ি বছর বয়সে ১৪৭২ সালে তিনি লাইসেন্স পেয়ে শিল্পীদের গিল্ড সেন্ট লুক কোম্পানির রেজিস্টার্ড সদস্য হন। ততদিনে লিওনার্দো ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত শিল্পী।
এখানে বলে রাখা ভাল যে তৎকালীন ইতালিতে শিল্পীরা ছিলেন মূলত কারিগর। তখন আর্ট স্কুল ছিল না, তাই বড় কোন শিল্পীর তত্ত্বাবধানে নবিশ হিসেবে শিল্পশিক্ষা করতে হত। অন্তত চার বছরের শিক্ষা না নিলে এবং ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন না করলে স্বাধীনভাবে কাজ করার লাইসেন্স পাওয়া যেত না। পুরো ব্যবস্থাটি আর পাঁচটি পেশার মতোই একটি গিল্ড-সিস্টেমের মধ্যে শৃঙ্খলার সঙ্গে চলত। শিল্পীদের শুধু ছবি আঁকা নয়, ভাস্কর্য, ধাতুর কাজ সব কিছুই শিখতে হত, কারণ ক্রেতারা তাঁদের যে কোনও অলংকরণ বা শিল্পসৃষ্টির কাজের জন্যে আসতে পারেন। বলাই বাহুল্য, সেসময় ক্রেতা বলতে চার্চ এবং তার আনুষঙ্গিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাজপরিবার, অভিজাত সম্প্রদায়, নগরপাল (রাস্তার সৌন্দর্যের জন্যে) ইত্যাদিরাই ছিলেন। তাই তখনকার শিল্পকর্মে বাইবেল ও গ্রীক মিথলোজির প্রাধান্য দেখা যায়।
তাঁর বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে রয়েছে শুভ ঘোষণা বা ‘অ্যানান্সিয়েশন’ (The Annuciation, 1472-73), ম্যাডোনা (Madonna, 1478), পাহাড়ের কুমারী বা ‘ভার্জিন অফ দ্য রকস’ (Virgin of the Rocks, 1482), শেষ নৈশভোজ বা ‘লাস্ট সাপার’ (Last Supper, 1498), পৃথিবীর রক্ষাকর্তা বা সালভাতোর মুন্ডি (Salvator Mundi, 1500) এবং ‘মোনা লিসা’ (Mona Lisa, 1503)। এই ছবিগুলি তিনি শেষ করে গিয়েছিলেন বা তাঁর আঁকা বলে স্বীকৃত। অন্যদিকে অনেক ছবি তাঁর নয়, অর্থাৎ তাঁর পদ্ধতি নকল করে আঁকা— তাঁর নামে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। আবার বহু ছবি তিনি শুরু করে শেষ করেন নি, এমনটিও হয়েছে।
রহস্যময়তা এবং এক প্রকার দুর্ভাগ্য লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জীবনসঙ্গী ছিল। ভাবলে অবাক লাগে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীর সুরক্ষিত ছবি বলতে যা রয়েছে তার সংখ্যা হাতে গোনা। তাঁর বেশির ভাগ কাজই তাঁর পারফেকশনিস্ট মনোভাবের জন্যে শেষ হয়নি। তাঁর ছাত্র ও অনুগামীরাও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করেন নি। অথচ তিনি ছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী। তাঁর এই পরিশ্রমের আর এক প্রমাণ হল দশ হাজার পৃষ্ঠার নোটবুক, যেখানে তাঁর অসংখ্য স্কেচ, ডিজাইন, বিভিন্ন চিন্তাভাবনা, এমনকী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার রোজনামচা, আর্ট সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ইত্যাদি লিখে রাখতেন। কবরখানা থেকে মৃতদেহ তুলে এনে তিনি কাটাকুটি করতেন। মানুষের অ্যানাটমি স্টাডি করা তাঁর একসময়ের নেশা ছিল। তাঁর নোটবইতে প্রচুর অ্যানাটমি ও কঙ্কালের স্কেচ রয়েছে। বস্তুত তাঁর উদাহরণ দেখেই পৃথিবীর সর্বত্র শিল্পীদের অ্যানাটমির জ্ঞান একরকম আবশ্যিক বলে ধরা হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কেও তাঁর অদম্য কৌতূহল ছিল।
এই নোটগুলি থেকে বোঝা যায় তিনি এক অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন— সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, গণিত, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্ত বিষয়ে তিনি অনেক কিছু জানতেন ও চর্চা করতেন। অথচ তাঁর প্রথাগত পড়াশোনা ছিল সামান্য। তিনি ছিলেন প্রকৃত রেনেসাঁস (বা রেনেসাঁ) ম্যান, অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, কৌতূহলী, মানবকেন্দ্রিক। তিনি জন্মেছিলেন ফ্লোরেন্সে, যেখানে তাঁর জন্মের মাত্র কয়েক দশক আগে রেনেসাঁস শুরু হয়েছে।
রেনেসাঁস মানে মধ্যযুগের শেষে অতীতের রোমান ও গ্রীক সভ্যতার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। শিল্পসংস্কৃতি দিয়ে এই ঢেউ শুরু হয়েছিল। ধর্মীয় চিত্রশিল্প বা ক্রিশ্চান পুরাণের গল্পগুলি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনা শুরু হয়। মানুষের রূপে, মানুষের আবেগ অনুভূতি দিয়ে দেব-দেবীদের দেখানো শুরু করেন শিল্পীরা। শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষ। আর এই কাজে লিওনার্দোর একার অবদানই এক শতাব্দীর সমতুল। লিওনার্দো যদি একশো বছর আগে জন্মাতেন, বা ফ্লোরেন্সে না জন্মে অন্য কোথাও জন্মাতেন, কী হত বলা মুশকিল।
এখানে সংক্ষেপে একটু ইতিহাসের কথা বলা যেতে পারে। পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী এই এক হাজার বছরকে মধ্যযুগ বলা হয়। মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের সূত্রপাতে রেনেসাঁস একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পশ্চিম ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের পতন দিয়ে মধ্যযুগের শুরু। উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজত্বের মধ্যে মারামারি, আক্রমণ ও ধর্মযুদ্ধ একরকমের চিরকালীন অশান্তির সৃষ্টি করে, যার পরিণামে সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও দর্শনের জগতে প্রায় এক হাজার বছর নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে যে জোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্য ক্লদিয়াস টলেমি জন্মান ১০০ খ্রিষ্টাব্দে, আর নিকোলাস কোপারনিকাস জন্মান ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে— চোদ্দশো বছর বাদে রেনেসাঁসের যুগে। এই চোদ্দশো বছরে আমরা কোনও বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে পাইনি। মধ্যযুগের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চাষবাস, ছোট ছোট শিল্প এবং পূর্ব এশিয়ার সাথে স্থলপথে বাণিজ্য (সিল্ক রুটের মাধ্যমে)। তখন সম্পদের দিক দিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক ধনী। পরে ষোড়শ শতাব্দীতে এসে ইউরোপের ভারসাম্য পাল্টে যায়। আমেরিকা আবিষ্কার ও ভাস্কো দা গামার ভারতে আসার মধ্যে দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন হয়। পশ্চিম ইউরোপ গোটা পৃথিবীতে আধিপত্য বসায়। সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
যেটা স্মরণীয় তা হল ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান, যা তাকে মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ উভয় সময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছে। ভেনিস, ফ্লোরেন্স ও জেনোয়া মধ্যযুগের অত্যন্ত ধনী এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর বা শহরভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, এবং আধুনিক যুগেও এদের রমরমা বজায় থাকে। জেনোয়া অঞ্চলেই কলম্বাস জন্মেছিলেন— রেনেসাঁস পর্বের আর একটি অবদান। যাই হোক, এই তিনটে শহরেই, ১৩৪৭-১৩৫৩ সালের প্লেগে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। ১৩৪৮ সালে ফ্লোরেন্সে প্রায় একলক্ষ মানুষ (বা শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা) মারা যায়। জিওভানি বোকাচিও তাঁর অমর গ্রন্থ ‘ডিক্যামেরনে’ লিখে গেছেন ফ্লোরেন্সের প্লেগ মহামারির কথা। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে এই মর্মান্তিক ও অভূতপূর্ব মৃত্যুর অভিজ্ঞতার জন্যে ফ্লোরেন্সবাসীরা মৃত্যুপরবর্তী স্বর্গজীবনের কথা ছেড়ে ইহজগতের মানবজীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।
ভাবনার এই মানবকেন্দ্রিকতাই রেনেসাঁসের বীজ হয়ে ওঠে। মানুষের আদলে দেবতাদের দেখা রেনেসাঁস শিল্পীদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, এবং আঁকার জগতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই ভাবনার প্রথম রূপকার। এটা বোধহয় বলা যেতে পারে লিওনার্দো না জন্মালে আমরা হয়তো মাইকেল্যাঞ্জেলো ও রাফায়েলকেও পেতাম না। দুজনেই বয়সে লিওনার্দোর থেকে ছোট এবং বিপুলভাবে লিওনার্দোর দ্বারা অনুপ্রাণিত। মাইকেল্যাঞ্জেলোর জন্মও ফ্লোরেন্সে। এই তিন শিল্পীকে উচ্চ রেনেসাঁসের (High Renaissance) ত্রয়ী প্রবাদপুরুষ বলা হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে লিওনার্দো যেমন হৈ-হল্লা করে উদার হস্তে পয়সা খরচ করতেন, তেমনি আবার নির্বান্ধব ছিলেন। বিবাহ করেন নি, কোনও সন্তান রেখে যাননি। কোন বিখ্যাত ছাত্রও তৈরি করে যাননি। নিরামিষ খেতেন এবং বাঁহাতি শিল্পী ছিলেন। তাঁর একটি অদ্ভুত অভ্যাস ছিল, তিনি ডান দিক থেকে বাঁদিকে উল্টো হরফে লিখতেন, যাকে mirror writing বলা হয়; অর্থাৎ আয়নার সাহায্য না নিলে সে লেখার পাঠোদ্ধার করা মুশকিল। এটা সম্ভবত নিছক খামখেয়ালি ব্যাপার ছিল। তিনি যৌবনে কেমন দেখতে ছিলেন, তা সঠিক ভাবে বলা মুশকিল, কারণ সেই বয়সের কোনও প্রতিকৃতি নেই। তবে সুদর্শন ছিলেন বলে কথিত। ষাট বছর বয়সে আঁকা এই আত্ম-প্রতিকৃতিটিই তাঁর একমাত্র ছবি বলে জানা যায়। অবশ্য অন্য শিল্পীদের গড়া কিছু প্রস্তরমূর্তি রয়েছে, কিন্তু সেগুলি তৈরি হয়েছে অনেক পরে।
১৫১৫ সালে ফ্রান্সের তরুণ রাজা ফ্রান্সিসের আমন্ত্রণে লিওনার্দো বরাবরের জন্যে ফ্রান্সে চলে যান। সেখানে তাঁকে জাতীয় শিল্পীর সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু সম্ভবত স্ট্রোক হওয়ার কারণে তাঁর শরীরের দ্রুত অবনতি হয়। ১৫১৯ সালের ২ মে তাঁর মৃত্যু হয়। মধ্য ফ্রান্সের অ্যাম্বোই শহরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। খামখেয়ালিময় এই অসাধারণ প্রতিভা তাঁর জীবৎকালে তো বটেই, বহু শতাব্দী বাদেও শিল্পীদের প্রভাবিত করে চলেছেন। চিত্রশিল্পে আধুনিক যুগের সূত্রপাত তাঁর হাত দিয়েই। তাই তাঁকে বলা হয় আধুনিক চিত্রকলার পিতা।