Categories
পুরাণপাড়া |

বিশ্বামিত্র

1719 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
কুলদারঞ্জন রায়

১৮৭৮-১৯৫০। শিশুসাহিত্যিক, মূলত অনুবাদক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভ্রাতা।

(বাঁদিক থেকে) প্রথম চিত্র: এই ছবিতে বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রর প্রথম আলাপের চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে। শিল্পী অজ্ঞাত। দ্বিতীয় চিত্র: রাম-লক্ষ্মণ ও অহল্যার সঙ্গে বিশ্বামিত্র; তৃতীয় চিত্র: রাজা দশরথের সভায় রামের জন্য এসেছেন বিশ্বামিত্র। এই দুটি ছবিই রাজা রবিবর্মার আঁকা। ঋণ: পুরাণের গল্প, Wikimedia Commons

মহামুনি বিশ্বামিত্রের কথা আমরা সকলেই জানি, কিন্তু তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার পূর্বে ছিলেন একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয় রাজা, সেকথা আমরা অনেকেই জানি না। কী করে বিশ্বামিত্রের মতো একজন পৃথিবী-বিখ্যাত রাজা হলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত মুনি, আজ সেই গল্পই বলব তোমাদের।

বিশ্বামিত্রের পিতা ছিলেন গাধি। পিতার মৃত্যুর পর বিশ্বামিত্র বহুকাল পৃথিবীতে রাজত্ব করেন। এই রাজত্বকালে একবার তিনি তাঁর বিরাট সৈন্যদল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। নানা দেশ, বিদেশ ঘুরে তিনি পৌঁছন মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে। বশিষ্ঠ মুনি রাজাকে দেখে, তাঁকে করজোড়ে সম্ভাষণ করে বলেন ‘আপনি সারা পৃথিবী ঘুরে যখন আমার মতো একজন মানুষের দরজায় পা রেখেছেন, তখন ক’টাদিন আমাকে আপনার এবং আপনার সেনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।’

রাজা বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ মুনির কথায় আপ্লুত হয়ে ওঠেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি মুনিকে বারবার বলেন ‘আমি অন্য সময় এসে আপনার আশ্রয় নিশ্চয়ই গ্রহণ করব, কিন্তু আজ আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিন।’ শেষমেশ মুনিবর যখন একেবারেই তাদের ছেড়ে দিতে নারাজ, তখন রাজা কয়েকটা দিন সেখানে কাটিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

রাজাকে থেকে যাওয়ার কথা বললেও, রাজা এবং তাঁর এতজন সঙ্গীসাথীর খাদ্যায়োজনের কথা মুনির মাথাতেই আসেনি। তাই খেতে দেওয়ার সময় তিনি পড়লেন গোলমালে, কারণ তাঁর আশ্রমে ফলমূল ছাড়া আর কিছুই ছিল না, আর রাজাকে তো শুধু ফলমূল খেতে দেওয়া যায় না। তাই তিনি অনেক ভেবে শেষমেশ গেলেন তাঁর শবলা নামে যে কামধেনুটি ছিল— তার কাছে। তাকে গিয়ে বললেন ‘মা শবলে, আমি রাজা বিশ্বামিত্র এবং তাঁর সৈন্যদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছি, এখন তুমি তাদের জন্য উপযুক্ত খাদ্যায়োজন করে আমার সম্মান রক্ষা কর।’

শবলা মুনির কথামতো খাদ্যসামগ্রীর এমন আয়োজন করল যে তা দেখে রাজা এবং তাঁর সৈন্যদল মুগ্ধ। সবাই ভীষণ খুশি মনে খেলেন। খাবার শেষে রাজা মুনির কাছে এসে করজোড়ে বললেন ‘মুনিবর আপনার আতিথেয়তায় আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। শুধু যাওয়ার আগে আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আপনার এই শবলাকে আমায় দান করুন।’

বশিষ্ঠ সেই শুনে বললেন ‘মহারাজ আমার কাছে সোনাদানা বা অন্য কোনও মহামূল্যবান সামগ্রী নেই। থাকার মধ্যে আছে এই শবলা, দয়া করে এটি আমার থেকে ছিনিয়ে নেবেন না।’ বিশ্বামিত্র তবু নাছোড়বান্দা, তিনি বললেন ‘শবলার সৃষ্টি করা খাদ্যের মত এমন সুস্বাদু খাবার আমি এর আগে খাইনি, আর শবলাকে না পেলে কোনওদিন খেতেও পাব না। তাই অনুগ্রহ করে ওকে আমায় দান করুন।’

কিন্তু তারপরেও বশিষ্ঠ মুনি শবলাকে দিতে রাজি না হওয়ায় বিশ্বামিত্র প্রচণ্ড রেগে যান এবং গায়ের জোরে শবলাকে নিয়ে সেখান থেকে গমন করেন।

শবলা মনের দুঃখে প্রাথমিকভাবে ভেঙে পড়লেও, পরমুহূর্তে সে ভাবতে শুরু করে বশিষ্ঠমুনির জন্য সে এত করল, তবু মুনি তাকে রাজার হাতে সঁপে দিলেন? প্রশ্ন মনে আসা মাত্রই শবলা গায়ের জোরে সব সৈন্যকে ফেলে দিয়ে মুনির আশ্রমের দিকে ছুটে এল। এসেই মুনিবরের পায়ের কাছে লুটিয়ে পরে বলল ‘আপনি এভাবে আমাকে অন্যের হাতে তুলে দেবেন না, আপনি যেভাবে হোক আটকান।’ মুনি বললেন ‘আমি একজন সামান্য ব্রাহ্মণ মা, এত সৈন্যদলের সামনে আমার কী ক্ষমতা আছে লড়াই করার।’ তখন শবলা বলল ‘তবে আমাকে অনুমতি দিন, আমি সৈন্য সৃষ্টি করে ওদের এখানে আমাকে নিতে আসা থেকে আটকাব।’ বশিষ্ঠ অনুমতি দেওয়া মাত্রই ‘হাম্বা হাম্বা’ রবে কয়েক হাজার সেনা তৈরি করল শবলা। তার তৈরি করা সৈন্যদল মুহূর্তে রাজার হাজার হাজার সেনাকে ধ্বংস করে দিল। এরপর রাজার একশত পুত্র যুদ্ধ করতে এলে, বশিষ্ঠমুনির একটিমাত্র হুঙ্কারে তারাও ভস্ম হয়ে গেল।

তখন অপমানে লজ্জায় বিশ্বামিত্র তার অবশিষ্ট একটিমাত্র পুত্রকে ডেকে বললেন ‘বাবা! এই মন নিয়ে দেশে গিয়ে রাজ্য চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি ফিরে গিয়ে নিজের মতো করে রাজ্য চালাও। আমি বনে গিয়ে মহাদেবের তপস্যায় জীবন অর্পণ করব।’ পুত্রের শত চেষ্টায়ও যখন বিশ্বামিত্র ফিরলেন না, তখন সে একাই রাজ্যে ফিরে গেল। আর বিশ্বামিত্র বনে গিয়ে মহাদেবের কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর সেই কঠিন তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে দেব, দানব, যক্ষ, গন্ধর্বের জানা সবরকমের ধনুর্বিদ্যা প্রদান করলেন।

বর পাওয়া মাত্রই প্রতিশোধ নিতে বিশ্বামিত্র গিয়ে হাজির হলেন বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে। সেখানে গিয়ে তিনি এমন অগ্নিবান বর্ষণ করলেন যে সমস্ত তপোবন আগুনে ধ্বংস হতে শুরু করল। সেই দেখে তপোবনবাসী সমস্ত মানুষ এবং ঋষিরা আতঙ্কে পালিয়ে যেতে লাগলেন, বশিষ্ঠ সকলকে ‘ভয় নেই, ভয় নেই’ বলে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তারপরও সকলে তপোবন পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। এই দেখে বশিষ্ঠ ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বামিত্রকে বললেন ‘দুরাচারী আমার পবিত্র আশ্রম আজ তুই এইভাবে নষ্ট করলি, এবার দেখ আমি তোর কী অবস্থা করি।’ এই শুনে বিশ্বামিত্রও ক্ষেপে উঠে বললেন ‘মহাদেবের বরে আজ আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, আমায় ধ্বংস করবে তুমি? তুমি দেখ এবার আমি কী করি।’ বলেই তিনি অগ্নিবান নিক্ষেপ করলেন মুনির দিকে। মুনির চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা নাচতে শুরু করল। সেই দেখে বিশ্বামিত্র যখন আনন্দে আত্মহারা, ঠিক তখনই বশিষ্ঠর দিব্যদৃষ্টিতে সব আগুন নিভে গিয়ে তপোবন শান্ত হয়ে গেল। কিন্তু বিশ্বামিত্র তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে উদ্যত হলেন। সেই দেখে কেঁপে উঠল ত্রিলোক, সবাই ভয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু বশিষ্ঠ সেই অস্ত্রকে মুহূর্তে শক্তিহীন করে দিয়ে বিশ্বামিত্রকে বললেন ‘তোমার ক্ষত্রিয় বলে ধিক্কার, আসল হল ব্রহ্মবল। আশা করি এখন সেটা তুমি বুঝে গেছ, তাই এখন ভালয় ভালয় আমার আশ্রম ত্যাগ করে তুমি চলে যাও।’

বিশ্বামিত্র চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি মনস্থির করলেন তিনিও ব্রাহ্মণ হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবেন। তাই তিনি নিজের রাজ্যে না ফিরে আবার বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করে দিলেন। সেই কঠিন তপস্যা দেখে প্রথমে দেবতারা তাঁকে ‘রাজর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করলেন, কিন্তু তিনি তাতেও খুশি না হয়ে আরও কঠিন তপস্যা শুরু করলেন। দেবতারা তখন তাঁকে ‘মুনি’ হওয়ার বর প্ৰদান করলেন। তবে তিনি তাতেও খুশি হলেন না। তখন তাঁর আরও কঠিন তপস্যা দেখে দেবতারা তাঁকে ‘ব্রহ্মর্ষি’ হওয়ার বরদান প্রদান করলেন এবং তাঁকে ও বশিষ্ঠ মুনিকে বুঝিয়ে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিলেন। ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্র এইভাবেই ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রতে পরিণত হলেন।

ঋণ: পুরাণের গল্প, কুলদারঞ্জন রায়। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।