আজ থেকে বহুকাল আগে দেবতারা যখন অমৃতের জন্য সমুদ্র মন্থন করেছিল, তখন অন্যান্য অনেক জিনিসের সঙ্গে উঠে এসেছিল একটি পারিজাত গাছ। গাছটির শোভায় মুগ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র সেই গাছটিকে নিয়ে এসে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব স্বর্গের বাগান নন্দনকাননে। এই গাছটিতে এত সুন্দর ফুল ফুটত আর তার গন্ধ এতটাই অপূর্ব যে তাতে গোটা দেবপুরীই মেতে উঠেছিল। এই গাছটি নিজগুণে ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবীরও সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
এইসময় একদিন পৃথিবী থেকে কৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সত্যভামাকে নিয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে ইন্দ্রাপুরীতে এলেন। কৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রীকে দেখে ইন্দ্র যারপরনাই খুশি হলেন। তিনি ওঁদের ভীষণ যত্নআত্তি করলেন। ফিরে যাওয়ার আগে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা পৌঁছে গেলেন নন্দনকাননে, সেখানে পারিজাত গাছটি দেখে সত্যভামার সেটি নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে হল। তখন তিনি কৃষ্ণকে বললেন ‘আচ্ছা এই গাছটা আমরা দ্বারকায় নিয়ে যেতে পারি না?’ সত্যভামার ভাললাগার কথা বুঝতে পেরে কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে গাছটা তুলে নিয়ে গরুড়ের উপর রাখলেন। কিন্তু কৃষ্ণের এইরকম আচরণ দেখে প্রহরীরা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন―‘এ আপনি কী করছেন? এটি দেবরাজ ও ওঁর স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় গাছ। এটি আপনি নিয়ে যাচ্ছেন শুনলে ওঁরা খুব বিরক্ত হবেন। তাই এই গাছ এখান থেকে আপনি কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন না।’ এই শুনে সত্যভামা রেগে গিয়ে বললেন―‘আমি শুনেছি এই গাছ সমুদ্র মন্থন থেকে উঠে এসেছে, তাই এই গাছে একমাত্র ওঁদের অধিকার থাকতে পারে না। এটা আমরা নিয়ে যাবই। তোমাদের দেবরাজের ক্ষমতা থাকলে আটকে দেখাক।’
প্রহরীরা এই খবর তুলে দিলেন শচীদেবীর কানে, তিনি শুনে ভীষণ রেগে গেলেন। ইন্দ্রকে বললেন― ‘তোমার সাম্রাজ্য থেকে তোমার অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু নিয়ে যাবে, এ জিনিস আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি এই মুহূর্তে যাও, ওঁদের আটকাও।’ শচীদেবীর কথায় ইন্দ্র বজ্র হাতে নিয়ে তার বাহন ঐরাবতে চেপে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন, সঙ্গে নিলেন অজস্র দেবসেনা। শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।
একদিকে হাজার হাজার সেনাসহ দেবরাজ ইন্দ্র, অন্যদিকে কৃষ্ণ একা। সেনাদের বাণে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারিদিক, কিন্তু মুহূর্তে সেইসব বাণ ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছেন কৃষ্ণ। এরমধ্যেই বরুণদেব কৃষ্ণের দিকে ছুঁড়লেন পাশ। কিন্তু কৃষ্ণের বাহন গরুড় সেটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। অন্যদিকে যমের অস্ত্র দণ্ড কৃষ্ণের গদায় লেগে ভেঙে হল খান খান। এমনকী কৃষ্ণের চক্রের আঘাতে কুবেরের রথটি ফালা ফালা হয়ে গেল। চন্দ্র এবং সূর্য কৃষ্ণের তেজ দেখে হলেন নিস্তেজ। অগ্নি কৃষ্ণের বাণে শতখণ্ড হয়ে গেলেন। অন্য দেবতারাও কৃষ্ণের বাণ ও চক্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, আর সৈনিকেরা গরুড়ের নখের আঁচড়ে আর ডানার ঝাপটে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে লাগল। এমন সময় ইন্দ্র তাঁর মোক্ষম অস্ত্র দধীচি মুনির হাড়ের তৈরি বজ্র নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। সেই দেখে কৃষ্ণও বের করলেন সুদর্শন-চক্র। দুটি অস্ত্র একসঙ্গে প্রয়োগ করলে ত্রিলোক কেঁপে উঠতে পারে, এই ভেবে সবাই কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু ইন্দ্র বজ্র প্রয়োগ করলেও কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র প্রয়োগ করলেন না, এমনকি বজ্রটিকেও অবলীলায় নিজের মুষ্টিবদ্ধ করলেন।
এই দেখে ইন্দ্র যখন পালিয়ে যাচ্ছেন তখন সত্যভামা তাকে বিদ্রুপ করে বললেন―‘যাবার আগে আপনার পারিজাত গাছটিও সঙ্গে নিয়ে যান। আমরা আপনার বাড়িতে অতিথি হিসেবে এসেছিলাম এবং আশা করেছিলাম অতিথিসেবায় আপনার মতোই আপনার স্ত্রী বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করবেন না। কিন্তু ওঁর অহংকার দেখে আমরা ইচ্ছে করেই এইরূপ গোলযোগ বাধিয়েছিলাম।’
সত্যভামার কথায় ইন্দ্র ফিরে এসে নতমস্তকে বললেন―‘দেবি, আমাদের ভুলের যথাযথ শাস্তি আমরা পেয়েছি। আর এমন কথা বলে আমাদের লজ্জা দেবেন না।’
ইন্দ্রের কথায় খুশি হয়ে কৃষ্ণ বললেন―‘আপনি দেবরাজ ইন্দ্র, এমন বৃক্ষ আপনার স্বর্গের বাগানেই শোভা পায়। আমরা মর্ত্যের লোক, আমরা এমন সুন্দর জিনিস কোথায় রাখব! সত্যভামার কথায় আমি নিয়েছিলাম বটে, তবে এখন আপনি আপনার জিনিস ফেরত নিয়ে আমাকে মার্জনা করুন। আর এই নিন আপনার বজ্র।’
বজ্র গ্রহণ করে জোড়হস্তে ইন্দ্র বললেন―‘আপনি মর্ত্যের লোক বলে আমায় ভোলাবেন না। আজ আপনি মর্ত্যে আছেন। তবে কাল যখন স্বর্গে ফিরবেন তখন আপনার সঙ্গেই এই বৃক্ষ ফিরে আসবে। আমার এই উপহার আপনি গ্রহণ করুন।’ এই বলে পারিজাত গাছটি তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন।
কৃষ্ণও সেই গাছটি খুশি মনে গ্রহণ করে সত্যভামার সঙ্গে গরুড়ের পিঠে চড়ে দ্বারকায় ফিরে এলেন।
ঋণ: পুরাণের গল্প, কুলদারঞ্জন রায়। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।