সে প্রায় অনেক বছর আগের কথা। তখন বাংলার সিংহাসনে আসীন ছিলেন ইলিয়াস-শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজমশাহ্ (১৩৯০-১৪১১)। তাঁর সুবিচারের কথা লোকশ্রুতিতে পরিণত হয়। একবার তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে লক্ষ্যভেদ অভ্যাস করছিলেন। সবার হাতেই তির-ধনুক ছিল। হঠাৎ তাঁর অসাবধানতায় হাত থেকে একটি তির লক্ষ্য হারিয়ে বিপথে চলে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেই তির গিয়ে আঘাত করে এক দুঃখিনী বিধবার পুত্রকে।
বিধবা বিন্দুমাত্র দেরি না করে কাজি সিরাজুদ্দিনের (কেউ কেউ বলেছেন সোহরাবুদ্দিন) আদালতে নালিশ করেন। কাজি পড়ে যান মহাবিপদে। ভাবতে থাকেন—‘যদি সুলতানকে তলব করি তবে তো সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা, কাজিগিরি করা ফুরিয়ে যাবে। আর যদি ন্যায়বিচার না করি, তবে খোদাতা’লার কী বিচার হবে? ন্যায়ের অবহেলার জন্য আমাকে তো জাহান্নামে যেতে হবে।’
কাজির মনের মধ্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব শুরু হল। দুনিয়ার সকল সুলতানের ওপর যে সুলতান তাঁর ভয়টাই কাজির কাছে সবথেকে বড় হয়ে উঠল। ভয় পেয়ে কাজি একজন আমলাকে পাঠালেন সুলতানকে আদালতে ডেকে আনার জন্য। আমলাটিও পড়ল মহামুশকিলে। কাজির হুকুম অমান্য করার সাহস যেমন তার ছিল না, তেমনই সটান রাজদরবারে গিয়ে সুলতানকে কাজির হুকুম জানানোর সাহসও তার ছিল না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার মাথাতেও একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
সে একটি মসজিদের চূড়ার ওপর উঠল এবং অসময়ে নামাজের জন্য আজান দিতে শুরু করল। অসময়ে আজান শুনে সুলতান হুকুম দিলেন, ‘কে এমন বেইমানি করছে, তাকে ধরে নিয়ে এসো!’
দরবারে ধরে নিয়ে গেলে লোকটি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘জাঁহাপনা, কাজি জনাবকে তাঁর এজলাসে তলব করেছেন। একথা জনাবকে জানাবার ফিকির খুঁজে না পেয়ে আমি আজান দিতে শুরু করেছিলাম।’
সুলতান আমলাকে ছেড়ে দিলেন এবং তখনই কাজির দরবারে গেলেন। জামার ভেতরে নিলেন একটা ছোট তরোয়াল।
সুলতান আদালতে উপস্থিত হলে কাজি তাঁকে কোনওরকম রাজসম্মান দেখালেন না, বরং বেশ গম্ভীর স্বরেই বললেন—‘তুমি অসাবধানে তির ছুঁড়ে এই বিধবার ছেলেকে ভীষণ আঘাত করেছ। তুমি যদি একে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা-পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট না কর, তাহলে তোমাকে দেশের আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে।’ সুলতান কাজিকে সেলাম করে সেই বিধবার কাছে গেলেন। নিয়মমতো ক্ষতিপূরণ বাবদ তাকে যথেষ্ট অর্থ দিয়ে সন্তুষ্ট করলেন। তারপর কাজিকে বললেন—‘খোদাবন্দ, বিধবা আমাকে মাফ করেছেন।’
কাজি বিধবার দিকে তাকালেন, বিধবা সম্মতি জানাতেই কাজি তাঁর আসন থেকে নেমে এসে সুলতানকে কুর্নিশ করলেন। সুলতান তখন জামার ভিতর থেকে ছোট তরোয়ালটি বের করে বললেন—‘কাজি, তোমার হাতে এই মুলুকের সমস্ত বিচারের ভার দেওয়া হয়েছে। তুমি যদি আমার ভয়ে বিন্দুমাত্র আইনের অমর্যাদা করতে, তাহলে এই তরোয়াল দিয়ে আমি তোমার মাথা কেটে ফেলতাম। কিন্তু সুখের বিষয় এটাই যে, তুমি তোমার কাজ ঠিকমতো করেছ, এজন্য খোদাতা’লাকে ধন্যবাদ দিই। আমি আরও খুশি এই জেনে যে, আমার রাজ্যে এমন এক কাজি আছেন যিনি দেশের আইনের ওপর সুলতানের কর্তৃত্ব স্বীকার করেন না।’
কাজি একটি চাবুক হাতে নিয়ে উত্তর দিলেন—‘আর আমিও খোদার নাম শপথ করে বলছি যে আপনিও যদি পবিত্র কোরানের বিধি না মানতেন, তাহলে এই চাবুক দিয়ে আপনার পিঠে কালশিটে ফেলে দিতাম। যাক, ভালয় ভালয় সব মিটে গেছে। আজ আমাদের দুজনেরই কঠিন পরীক্ষার দিন ছিল।’
সুলতান খুশি হয়ে কাজিকে প্রচুর পুরস্কার দিলেন।
ঋণ: পুরাকথিকা, নীতীন্দ্র রায়; প্রেম কাব্য রক্ত, কালকূট