Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

কোণারক ও ধর্মপদ

1256 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
জয়তী ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপনকর্মী ও প্রাক্তন রেডিওকর্মী

অলংকরণ: সৌম্যেন সরকার

বাঙালির কাছে সমুদ্রভ্রমণ মানেই পুরী, আর পুরী মানেই জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শনের পাশাপাশি কোণারক মন্দিরেও ঘুরে আসা। কোণারক মন্দিরের কাছেই রয়েছে চন্দ্রভাগা, যেখানে মহানদীর একটি শাখা মিশেছে সমুদ্রে। কথিত আছে এখানে স্নান করে সূর্য পুজো করেছিলেন বলেই শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব কুষ্ঠ মুক্ত হয়েছিলেন। তাই মাঘী পূর্ণিমাতে অনেকেই নিজের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে এখানে পুজো দিতে আসেন। কিন্তু এই কোণারক মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মপদের নামও, সেটা আমরা অনেকেই জানি না। কীভাবে? জানতে গেলে চলে যেতে হবে সেই সময়ে, যখন উড়িষ্যার রাজা ছিলেন লাঙ্গুলা নরসিংহ দেব।

উড়িষ্যার রাজা যখন ছিলেন পুরন্দর কেশরী তখন তিনি একটি সূর্য মন্দির স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু তারপর হাজার বছর কেটে যাওয়ায় মন্দিরের অবস্থা ছিল জরাজীর্ণ, তাই নরসিংহ দেব ঠিক করলেন নতুন মন্দিরটি ভেঙে বড় করে সূর্যমন্দির তৈরি করবেন, যে মন্দিরের ভিত্তি থাকবে জলের নীচে আর মন্দিরের মধ্যে থাকবে একটি চুম্বক, যার ফলে সমুদ্র দিয়ে যাওয়া সব জাহাজই নোঙর ফেলে মন্দিরে পুজো দিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

নরসিংহ দেব ঠিক করলেন এই মন্দির তৈরি করতে তিনি উড়িষ্যার বারো বছরের সংগ্রহ করা কর খরচ করবেন। এরপর তাঁর নির্দেশেই বিশু মহারাণার অধীনে এই কাজের জন্য বারোশো স্থাপত্যশিল্পী নেওয়া হল এবং কাজের তদারকির জন্য রাজমিস্ত্রি শিবসামন্ত রায়কে নিয়োগ করা হল। কিন্তু কাজ শুরু করার পরই দেখা দিল সমস্যা, চন্দ্রভাগার গভীরতা কমানোর জন্য সামন্ত রায়ের নির্দেশে বড় বড় পাথর ফেলা হলেও গভীরতা কোনওভাবেই কমানো গেল না। ফলে সকলেই পড়লেন চিন্তায়। কিন্তু শিবসামন্ত রায়কে চিন্তামুক্ত করলেন এক অপরিচিতা বৃদ্ধা। একদিন ঘুরতে ঘুরতে তিনি এই বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। খাওয়ার সময় শিবসামন্ত রায় যখন গরম খাবার মাঝখান থেকে খাবলা খাবলা করে তুলে খেতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন ওই বৃদ্ধা অজান্তেই বললেন, ‘ও কীরকম খাওয়া গা? গরম জিনিস একপাশ থেকে অল্প অল্প করে খাও, মাঝখান থেকে ভেঙে ভেঙে খেলে তো গরম কখনই কমবে না।’ এই শুনে সামন্ত রায় প্রাথমিক ভাবে লজ্জা পেলেও পরে বুঝলেন তাদের ভুলটা ঠিক কোথায়। ফিরে এসে তিনি শিল্পীদের নির্দেশ দিলেন একপাশ থেকে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করার। নির্দেশমত কাজ এগোতে লাগল তরতরিয়ে।

কাজ করতে করতে পেরিয়ে গেল বারো বছর, বারোশো শিল্পী দিনরাত কাজ করে আর নিজেদের পরিবারের কথা ভাবে, কারণ এই কাজের জন্য বহুকাল তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এরমধ্যেই বিশু মহারাণার ছেলের বয়সও বাড়তে লাগল। মাঝেমধ্যে রাজার বাহকের হাতে পরিবারের থেকে চিঠি আসে। সেখান থেকে ছেলের কথা জানতে পারেন। যখন তিনি পরিবারকে ছেড়ে আসেন তখন তার স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা, এরপর ছেলে হলে তার নাম রাখা হয় ধর্মপদ, সকলে আদর করে তাকে ধর্মা বলে ডাকে। ধর্মা নাকি পড়াশুনায় দারুণ এবং সে নাকি অন্য ছেলেদের মতো দুষ্টমি করে না, বরং শান্ত হয়ে বসে সারাক্ষণ কীসব ভাবে আর পাথরে মন্দিরের নকশা বানায় ছেনি হাতুড়ি দিয়ে বা অঙ্ক কষে। কিন্তু তার কোনও গুরু নেই, তবু সে নিয়ম করে লেখাপড়া করতে ভোলে না। এইসব খবর চিঠিতেই আসত মাঝেমাঝে, আর চিঠি পড়ে ছেলেকে একবার দেখার জন্য মন ছটফট করত বিশু মাহারাণার।

এদিকে ধর্মপদ যখন জানতে পারল তার পিতা সুদূর উড়িষ্যায় মন্দির নির্মাণের কাজই করছেন, তখন সে সেখানে গিয়ে তার পিতাকে দেখার জন্যে উতলা হয়ে উঠল। কিন্তু বাধ সাধল তার মা, কারণ এই মন্দির নির্মাণের জন্যই তিনি গত বারো বছর তাঁর স্বামীকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পাননি। কিন্তু ধর্মপদ তার সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর, তাই বাধ্য হয়েই তার মাকে অনুমতি দিতে হল। এরপর ধর্মপদ রাজার এক চিঠিবাহকের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল উড়িষ্যার উদ্দেশে। অন্যদিকে মন্দিরের সব কাজ শেষ হয়ে গেলেও চূড়ায় কলসটি বসানোর কাজ তখনও অসম্পূর্ণ, শিল্পীদের শত শত চেষ্টাও বৃথা। এসব দেখে নরসিংহ দেব লক্ষ লক্ষ টাকা এবং সময় খরচ করার পর আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। তিনি নির্দেশ দিলেন, দুদিনের মধ্যে যদি কাজ সম্পূর্ণ না হয় তবে তিনি ওই বারোশো শিল্পীর মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেবেন।

ঘোষণা করার দিনই সেখানে গিয়ে পৌঁছায় ধর্মপদ। বিশু মহারাণা তার পরিচয় পেয়ে আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠে বলেন, ‘বাবা!! তোকে একটিবার না দেখলে আমি মরেও শান্তি পেতাম না। এবার আমি নিশ্চিন্ত।’ কিন্তু ধর্মপদ এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, সে বলল, ‘আমি কাউকে কিচ্ছু হতে দেব না। আমাকে তোমরা একটিবার মন্দিরের চূড়ায় উঠতে দাও, আমি সব ঠিক করে দেব।’ প্রথমে সবাই রাজি না হলেও শেষমেশ ধর্মপদের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হল।

ধর্মপদ উঠল মন্দিরের চূড়ায়, সেখানে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরই সে ধরে ফেলল সমস্যাটা কোথায়। তারপর নিজের হাতে চুম্বক থেকে সরে যাওয়া একটি লোহার শিককে ঠিক জায়গা মতো লাগিয়ে দেওয়ার পরই কলসটি চূড়ায় প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল অনায়াসে। কিন্তু তার এই দক্ষতা দেখে বারোশো শিল্পী নিশ্চিন্ত হলেও আনন্দিত হতে পারল না। কারণ তাদের মনে হতে লাগল রাজা যদি জানতে পারেন যে একটি বালক যা কয়েক মুহূর্তে করে দিতে পারল তা তারা অতজন মিলে অতদিনেও করতে পারেনি তবে প্রাণদণ্ড অনিবার্য। তাই তারা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিল এই খবর তাদের মধ্যেই গোপন থাকবে, এবং এরজন্য প্রাণ বলিদান দিতে হবে ধর্মপদকে।

সকলে মিলে গেল সর্দার বিশু মাহারানার কাছে, বলল ‘কাকে চাও? বারোশো সহকর্মী নাকি একজন সন্তান?’ একথা শুনে সর্দার ভয়ে কাঁপতে লাগলেন, কার কথা বলবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু সমস্যার সমাধান করে দিল ধর্মপদ। পিতাকে সে বলল ‘আমাকে তুমি ছেড়ে দাও বাবা। তোমার সহকর্মীরা থাকলে এরকম আশ্চর্য নির্মাণ করতে আমার মতো অজস্র ধর্মপদ জন্মাবে। মাকে বোলো জাতির মঙ্গলের জন্য আমি নিজেকে আহুতি দিলাম।’ বলেই সে মন্দিরের চূড়া থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নিজের প্রাণ বলিদান দিল। এই দেখে সর্দার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে, কিন্তু আজও কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না—‘বারোশো শিল্পী বড় না ধর্মপদের মত একজন গুণী ব্যক্তিত্ব?’

ঋণ: পুণ্য কাহিনি, জয়দেব রায়; www.thekonark.in