Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

পাড়ার পাখি শালিক

1701 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সুপ্রিয়া সরকার

প্রকৃতি সংসদের সদস্যা

চিত্র: সৌভিক গুহসরকার

বারান্দায় বসে বইয়ের পাতায় চোখ রাখি; খানিকবাদেই কানের কাছে ক্রিউচ, ক্র্যাক ক্র্যাক চেক চেক চরর চরর ইত্যাদি বিবিধ রকমের আওয়াজে চোখ তুলে তাকাই। দেখি বারান্দার রেলিং-এর ওপর বসে আছে একটি শালিক পাখি। Common Myna (২৫ সেমি)। বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres tristis। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এবং বিচিত্র আওয়াজ করে ওর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কাক, চড়াই ইত্যাদি পাখি ছাড়া মানুষের খুব কাছাকাছি সবচেয়ে গা-ঘেঁষে যে পাখি বাস করে, সে হল শালিক। শালিক স্ত্রী-পুরুষ একই রকমের দেখতে। গাঢ় বাদামী গায়ের রং তলপেটের কাছে ক্রমশ ফিকে হয়ে এসে বাকি অংশ সাদা হয়ে গেছে। লেজের ডগা গোলাকার ও কয়েকটি পালকের প্রান্তে সাদা ছোপ আছে। মাথা, গলা ও বুক চকচকে কালো। ঠোঁট, পা ও চোখের পেছনের ত্বক উজ্জ্বল হলুদ। বাচ্চা শালিকগুলোর গায়ের রং বড়দের তুলনায় অনেকটাই ফ‍্যাকাশে।

আবাসস্থল: শালিক এই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গাতেই এদের দেখতে পাওয়া যায়।

বিচরণ ক্ষেত্র: শালিক মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে। তাই যে কোনও লোকালয়, সে গ্রাম অথবা শহর, যাই হোক না কেন, তার আনাচে কানাচে এদের দেখা যায়। এছাড়া চাষজমি ও জলা জায়গাতেও এদের অবাধ গতিবিধি।

স্বভাব: শালিক প্রচণ্ড ঝগড়াটে স্বভাবের পাখি। একা-একা, জোড়ায় অথবা ছোট বড় ঝাঁক বেঁধে এরা ঘুরে বেড়ায়। যখন জোড়ায় থাকে তখন মনে হয় দুজনের মধ্যে খুবই ভাব। একসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, এ ওর গা চুলকে দিচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দেখা যায় তুলকালাম ঝগড়া বেঁধে গেছে। কোনও সাপ বা নেউল অথবা বাজ জাতীয় পাখি দেখলেই এরা ঝাঁক বেঁধে প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামিচি করে আশপাশের সবাইকে সতর্ক করে দেয়। কথা শেখালে শালিক বেশ কথা বলতে পারে।

খাদ্য: শালিক যা পায়, তাই খায়। ফল, পাকু্ড়, ধান, গম ইত্যাদি শস্য। ফড়িং, ঝিঁঝিঁপোকা, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি নানারকমের কীট-পতঙ্গ। এছাড়া কেঁচো, শামুক, ব্যাঙ এবং ফুলের মধুতেও এদের সমান আগ্রহ দেখা যায়। এমনকি আবর্জনা থেকেও এদের খুঁটে খেতে দেখা যায়। কোনও কিছুতেই বাছবিচার নেই।

বাসা: সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে একটা কোটর আছে। সেদিন দেখি কোটরের আশেপাশে প্রচণ্ড ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছে দুটি শালিক পাখি। মাঝেমধ্যেই একটি পাখি কোটরে ঢুকছে এবং কিছুক্ষণ বাদেই ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরিয়ে আসছে। প্রায় সারাদিন ধরেই চলে ওদের আনাগোনা। ব্যস্ততা দেখে মনে হয় ওই পাখির ছানাগুলো বোধহয় ওই গাছের কোটরেই আছে। গাছের কোটর ছাড়াও তাল-নারকেলের পাতার খাঁজে, বাড়ির আনাচে কানাচে, দেওয়ালের ফাটলে ও কার্নিশের তলায়ও এরা বাসা বাঁধে। কখনও ছোট ঝোপ, লতানে গাছে, এমনকী চিল, কাক বা কাঠবিড়ালির পরিত্যক্ত বাসাতেও এদের বাসা বানাতে দেখা যায়। গাছের ডালপালা, শিকড়বাকড় ইত্যাদি নানারকমের আস্তরণ বিছিয়ে বাসা বানানো হয়। এছাড়া ময়লা কাগজ, শুকনো ঘাস, খড়, কাঠি, পালক ও যতরকমের আবর্জনা দিয়ে এলোমেলো এবং অগোছালো-ভাবে বাসা তৈরি হয়।

প্রজননকাল: এপ্রিল থেকে অগাস্ট মাস এদের বাসা বানানোর এবং ডিম পাড়বার সময়। স্ত্রী-পুরুষ দুজনেই মিলেমিশে বাসা বাঁধে ও ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা প্রতিপালন করে। একই বছরে দু’বারও ডিম পাড়তে দেখা যায়। সাধারণত, একসাথে ৪টে থেকে ৫টা, কখনও বা ৬টাও ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর গা চকচকে, ফিকে সবজেটে নীল অথবা আকাশী নীল রঙের হয়।

ইদানীং লক্ষ্য করি গাছের কোটরের আশে পাশে শালিকগুলোকে আর দেখা যায় না। এপাশ ওপাশ দেখি। নজরে পড়ে একটি টিনের চালার ওপর বসে আছে একটি শালিকছানা। পাশে আরেকটি শালিক, সম্ভবত, ছোট শালিকটির বাবা অথবা মা। ছোট শালিকটি উড়ে যেদিকে যায়, বড়টিও উড়ে গিয়ে বসে। তবে ছোটটি বেশি দূর উড়তে পারে না। এইভাবেই বেশ কিছুদিন কাটে। হঠাৎ একদিন ছোট শালিকটিকে আর কোথাও দেখতে পাই না। আরও কয়েকটা দিন কেটে যায়। শালিকের ঝাঁক মাঠের ভেতর দল বেঁধে বসে থাকে। গাছের ডালে লাফালাফি করে, কিন্তু ছানাটাকে আলাদাভাবে বুঝতে পারি না। সে হয়তো বা উড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোনও শালিকের দলের সঙ্গে। তার নিজের জগতে।

ঋণ: The Book of Indian Birds, Salim Ali; বাংলার পাখি, অজয় হোম; বাংলার পাখপাখালি: প্রথম খণ্ড, কনাদ, সন্দীপ, শান্তনু, ক্ষৌণীশ