Categories
কমিক্সকুটির |

জোকারনামা

936 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

অভিনেতা, রেডিও উপস্থাপক ও কমিক্স-উৎসাহী

(বাঁদিক থেকে) জোকারের ভূমিকায় জ্যাক নিকোলসন (ব্যাটম্যান), হীথ লেজার (দ্য ডার্ক নাইট), ওয়াকিন ফিনিক্স (জোকার) এবং জ্যারেড লেটো (সুইসাইড স্কোয়াড)

জ্যাক নিকোলসন, হীথ লেজার, ওয়াকিন ফিনিক্স, জ্যারেড লেটো . . . না, হলিউড-এর শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভিনেতাদের নাম পর পর লিখে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে ঘটনাচক্রে এই চার শিল্পী এক অদ্ভুত মায়ার তারে বাঁধা। সেই মায়ার মুখ সাদা, চুল সবুজ, ঠোঁট লাল। সেই মায়া বিংশ শতাব্দীতে সৃষ্টি হওয়া জনপ্রিয়তম এবং ভয়ঙ্করতম কাল্পনিক চরিত্রগুলোর একটা। সেই মায়া, ‘দা ক্লাউন প্রিন্স অফ ক্রাইম’— ‘দা জোকার’। জোকার কে? এর উত্তর একাধিক। একদম প্রথম থেকে শুরু করা যাক।

১৮৬৯ সালে, ফরাসি সাহিত্যিক, ভিকটার হুগোর লেখা, ‘দা ম্যান হু লাফস’ নামক একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।

(বাঁদিক থেকে) জোকার, চিত্র সৌজন্য: জোকার আর্ট ডিসি কমিক্স; দ্য ম্যান হু লাফস্‌, ইলাস্ট্রেটেড ক্লাসিক্স কভার; গুইনপ্লেইন-এর চরিত্রে কনরাড ভাইড

এই গল্পের প্রধান চরিত্র একটি লোক যার নাম ‘গুইনপ্লেইন’। ছোটবেলায় দুষ্টু লোকেরা অস্ত্রোপচার করে গুইনপ্লেইন-এর বদন বিগড়ে দেয়— মানে ওর গাল কেটে এমন ভাবে সেলাই করে দেয় যে ওর দিকে তাকালেই মনে হয় ও হাসছে। সেই চিরহাস্য গুইনপ্লেইনকে বড়-পর্দায় ১৯২৮ সালে প্রথম রক্তমাংসের মানুষ করে তুললেন ‘Conrad Veidt’ (ছবির নাম: ‘দা ম্যান হু লাফস’)।

ঠিক তার বারো বছর পর— ১৯৪০-এ, গুইনপ্লেইনের চরিত্রে কনরাড ভাইডের একটা ছবি আর একটা ক্লাউন আঁকা তাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিল ফিঙ্গার, বব কেন্‌ এবং জেরি রবিনসন জন্ম দিলেন জোকারকে। ‘ব্যাটম্যান’ (ভলিউম 1) #1-এ পার্শ্বচরিত্র হিসেবে ভাবা হয়েছিল জোকারের কথা। ঠিক ছিল ওই একই সংখ্যায় হৃৎপিণ্ডে ছুরি ঢুকে তার মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ‘ডিসি কমিক্স’-এর তখনকার সম্পাদক, উইট্‌নি এলসওয়ার্থ এটা নামঞ্জুর করলেন। অতএব তড়িঘড়ি একটা প্যানেল যোগ করা হল যাতে দেখানো হল যে জোকার মরেনি। তারপর ৮0 বছরে শুধু বড় পর্দাতেই জোকারের চরিত্রে অভিনয় ক’রে অভিনেতারা মোট ১২০টা আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও নমিনেশন পেয়েছেন, যা বলাই বাহুল্য, নজিরবিহীন।

যারা ডিসি কমিক্স-এর এই নির্দিষ্ট চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত, তারা সকলেই জানবে যে— জোকার, জোকার হওয়ার আগে কে ছিল— সেই নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এই নিয়ে অনেক থিওরি রয়েছে। শুধু সিনেমা দিয়ে গুনলেই জোকারের ওরিজিন নিয়ে চারটে আলাদা ভাবনা রয়েছে। টিম বার্টনের ব্যাটম্যান-এ জ্যাক নিকোলসন জোকার হওয়ার আগে ছিল ‘রেড হুড গ্যাং’-এর নেতা, ‘রেড হুড ওয়ান’। সম্প্রতি ‘টড ফিলিপ্‌স্‌’ পরিচালিত ‘জোকার’-এ আর্থার ফ্লেক আবার ছিল সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এছাড়াও মজার ব্যাপার হল, জোকার সম্বন্ধে যেটা সবচেয়ে জনপ্রিয় থিওরি, সেটা হল— একটা লোক একটি কেমিক্যালে ডুবে গিয়েছিল এবং সেই জন্যে তার চামড়া সাদা এবং চুল সবুজ হয়ে যায়। অতঃপর, সে নিজের পরিচয় জোকার বলে দেয়। এই নির্দিষ্ট থিওরি জ্যাক নিকোলসন এবং জ্যারেড লেটোর জোকারের ক্ষেত্রে খেটে গেলেও ওয়াকিন ফিনিক্স এবং হীথ লেজারের জোকারের ক্ষেত্রে খাটে না, কারণ এই দুই জোকারই নিজেদের মুখে নিজেরা সাদা রং লাগান; তাদের চামড়া ও চুলের স্বাভাবিক রং সাদা বা সবুজ নয়। আবার এও পরিষ্কার যে ‘দা ডার্ক নাইট’-এর জোকার এবং ‘জোকার’-এর আর্থার ফ্লেক, দু’জন আলাদা মানুষ। সিনেমা ছাড়াও, জোকার আগে কে ছিল সেই নিয়ে প্রচুর থিওরি আছে। সেগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তমটি পাবে অ্যালান মুরের লেখা, ব্রায়ান বোল্যান্ড-এর ইলাস্ট্রেট করা, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত, ‘ব্যাটম্যান: দা কিলিং জোক #1’-এ। এটাতেও ওই কেমিক্যালের কারণেই চুল ও চামড়া পরিবর্তিত হয়, তবে আবারও মানুষটা আলাদা, মানে জোকার হওয়ার আগেও। বাকিটা বললাম না। পড়ে দেখো।

(বাঁদিক থেকে) দ্য কিলিং জোক-এর প্রচ্ছদ, হারলে কুইন-এর গল্প থেকে একটি পাতা; চিত্র সৌজন্য: ডিসি কমিক্স

এই যে জোকার, জোকার হওয়ার আগে কে ছিল সেই নিয়ে এত জল্পনা-কল্পনা— আমার মতে তার মূলত দুটো কারণ। এক, জোকার নিজেই সেটা চায়। সে নিজেই নিজের অতীত নিয়ে প্রচুর ‘মিথ’ তৈরি করেছে— মানে উপরোক্ত প্রত্যেকটা ওরিজিন তার নিজেরই বলা বা রটানো। বলা হয় এতে নাকি ওর সবাইকে মগজ ধোলাই করতে এবং তাদের আবেগ নিজের কাজে লাগাতে সুবিধা হয়। যেমন ধরো ঘটেছিল ‘হারলে কুইন’-এর ক্ষেত্রে, যে জোকার-এর প্রেমে পড়ার আগে ছিল তারই মনস্তত্ত্ববিদ, ‘হার্লিন কুইনসেল’।

একবার জোকার নিজের ছোটবেলার সম্বন্ধেও বলেছিল যে, ও নাকি ছোটবেলায় ওর ‘আন্ট ইউনিস’-এর কাছে থাকত— যে ওকে খুব অত্যাচার করত এবং ওকে পরিষ্কার রাখার জন্য ওর গায়ে ব্লিচ ঘষত। সত্যি কথা বলতে, নিজের কষ্টকর ছোটবেলার কথা শুনিয়ে পার পেয়ে যেতে হালফিলে অনেককেই দেখেছি আমরা। ভুল বুঝো না, কষ্টকে ছোট করছি না, ধাপ্পাবাজিটাকে করছি। এবার তুমি কোন ওরিজিনটা বিশ্বাস করবে বা করবে না, তা তোমার ব্যাপার। দুই, জোকার কি সত্যি শুধু একটাই মানুষ? না একই মতে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন মানুষ, যাদের কোনও কোনও সময়ে দেখতে এক লাগে? তারা কখনও থাকে দল বেঁধে, কখনও বা তোমার পাশে বসে, হয়তো এইরকমই একটা লেখা পড়ে। চুল রং করতে আর কতক্ষণ। ‘দা কিলিং জোক’-এ জোকার বলে, ‘All it takes is one bad day to reduce the sanest man alive to lunacy’। অর্থাৎ, ‘শুধুমাত্র একটা দিন যদি কারুর যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ যায়, তাহলে স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক-এর মাঝখানের দাগটা মুছে যেতে পারে’। এবার যদি জিজ্ঞেস করো জোকার কোথায়, তাহলে বলতে হয়, সে ভারী শক্ত হিসেব। মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তার সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর।

বাঁদিক থেকে: জোকারের ছেলেবেলা; জোকারের মুখোশ; চিত্র সৌজন্য: ডিসি কমিক্স

ঋণ স্বীকার: DC Comics Encyclopaedia