Categories
ইতিহাসতলা |

অসামান্য শিল্পীর অনন্য পশুপ্রেম

1122 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সর্বজিৎ মিত্র

ইতিহাস গবেষক, SOAS University of London

(বাঁদিক থেকে) প্রথম চিত্র: কোলসওয়ার্দি গ্রান্টের প্রতিকৃতি, শিল্পী অজ্ঞাত; দ্বিতীয় চিত্র: কোলসওয়ার্দি গ্রান্টের আঁকা বর্মার ছবি; চিত্র সৌজন্য: Wikipedia

রাইটার্স বিল্ডিং-এর ফুটপাথ ধরে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জা অথবা লালবাজারের দিকে হাঁটলে, ফুটপাথের ওপরেই একটি পুলিশ গুমটির পাশে একটা ছোট সাদা স্মৃতিস্তম্ভ চোখে পড়বে। স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ার জন্য অবশ্য রাস্তায় নামতেই হবে। যদি পুলিশকে বুঝিয়ে বা তার চোখ এড়িয়ে মিনিট খানেকের জন্য রাস্তায় নেমে পড়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই স্মৃতিস্তম্ভটি কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট নামক এক ইংরেজের স্মৃতির উদ্দেশে তাঁর বন্ধুরা নির্মাণ করেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ইংরেজ রাজত্ব তখন মধ্যগগনে আর সেই রাজের কেন্দ্রস্থল ছিল এই রাইটার্স বিল্ডিং বা পরবর্তীকালের মহাকরণ। অথচ এই গ্রান্ট কোনও সরকারি আমলা ছিলেন না, ছিলেন না কোনও লাট বা সামরিক বিভাগের প্রধান। দু-একটি ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে দেখা যাবে ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব স্মারকই সাম্রাজ্যবাদের দম্ভ প্রকাশ করছে। এই দু-একটি ব্যতিক্রমের মধ্যেই পড়বে ইংরেজ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই অকিঞ্চিৎকর স্মৃতিস্তম্ভটি। কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট নিজেই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। পেশায় শিল্পী, এই মানুষটি স্বভাবতই ছিলেন সংবেদনশীল এবং সেই আমলেই অনুভব করেছিলেন যে আশেপাশে পশুদের প্রতি হয়ে চলা বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রান্ট সেই উদ্দেশ্যে কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে গড়ে তোলেন পশু পীড়ন নিবারণী সংস্থা বা Society for the Prevention of Cruelty to Animals। গ্রান্টের প্রয়াণের পরে সংস্থার বন্ধুরাই প্রতিষ্ঠাতাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে এই ছোট্ট স্মারকটি প্রতিষ্ঠা করেন।

গ্রান্টের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ খ্যাত টেকচাঁদ ঠাকুর বা বলা ভাল প্যারীচাঁদ মিত্র। গ্রান্টের প্রয়াণের কিছুকাল পরেই প্যারীচাঁদ তাঁর একটি জীবনী লেখেন। গ্রান্টের নিজের লেখা বাদ দিলে প্যারীচাঁদ-রচিত এই জীবনী ওঁর সম্বন্ধে আমাদের প্রধান তথ্যসূত্র। প্যারীচাঁদের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি, গ্রান্ট মাত্র তেরো বছর বয়সে কলকাতায় পদার্পণ করেন ১৮৩২ সালে। আমরা আগেই বলেছি পেশাগত দিক দিয়ে গ্রান্ট ছিলেন শিল্পী। গ্রান্টের শিক্ষাপর্ব সম্বন্ধে যদিও কিছুই প্রায় জানা যায় না। প্যারীচাঁদ লিখেছেন অল্পবয়সেই গ্রান্ট নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৩০-র দশকের শেষ থেকেই সেই সময়ের কলকাতার প্রায় সবকটি প্রধান পত্রিকা যেমন— ইন্ডিয়ান রিভিয়ু, ক্যালকাটা রিভিয়ু, ক্যালকাটা ক্রিশ্চান অবজার্ভার, ইন্ডিয়ান স্পোর্টিং রিভিয়ু, সর্বত্রই গ্রান্টের আঁকার নিদর্শন দেখা যেত। এখানে স্বীকার করে নেওয়াই উচিত, স্রেফ পশুপীড়ন নিবারণী সংস্থার জন্যেই নয়, কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট শিল্পী হিসেবেও সমকালীন কলকাতায় যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছিলেন। গ্রান্টের শিল্পী জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ হল সেই সময়ের কলকাতার ১৬৯ জন নামজাদা ব্যাক্তিত্বের স্কেচ আঁকা। শুধু শৈল্পিক কারণেই নয়, ঐতিহাসিক দিক দিয়েও পরবর্তীকালের জন্য এই কাজ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ১৬৯ জনের মধ্যে অনেকেরই চেহারার আর অন্য কোনও নিদর্শন নেই। যেমন সেই সময়ের মিন্টমাস্টার বা টাঁকশালের প্রধান জেমস প্রিন্সেপ। প্রিন্সেপই প্রথম সম্রাট অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। তবে একথা ভাবলে ভুল হবে যে গ্রান্ট শুধু মানুষের অবয়ব আঁকতেই দড় ছিলেন। গ্রান্টের বার্মা ও মূলনাথের নীলকুঠির দু’টি পৃথক ভ্রমণকাহিনিতে লেখার পাশাপাশি রেখাতেও ছিল সেখানকার বাড়িঘর, জনজীবনের ছবি।

গ্রান্ট একই সময়ে কলকাতায় ইংরেজদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটি হাল্কা চালের লেখা লেখেন। এই লেখাটি ছিল মূলত বিলেতে তাঁর মা-কে লেখা বিভিন্ন চিঠির সংকলন। এই লেখাটি থেকে একটা জিনিস ক্রমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে— সেটা হল কলকাতা শহরের প্রতি গ্রান্টের অকৃত্রিম টান ও দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতার প্রথম নিদর্শন দেখা যায় ক্যালকাটা মেকানিক্স ইনস্টিটিউশনের সূত্রে। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে ১৮৩৯ সালে, ভারতীয়দের কার্যকরী শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। গ্রান্ট যোগ দেন ড্রয়িং-এর শিক্ষক হিসেবে। যদিও ক্যালকাটা মেকানিক্স ইনস্টিটিউশন বেশিদিন টেকেনি, তবু এর মধ্যে পরবর্তীকালের দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বীজ নিহিত ছিল— বিই কলেজ ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ। গ্রান্ট বিই কলেজের সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠাকাল থেকে। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে গ্রান্টের জনপ্রিয়তার চিহ্ন আজও খুঁজে পাওয়া যাবে শিবপুরে বিই কলেজের অডিটোরিয়ামের একটি ফলকে।

(বাঁদিকে) রাইটার্সের সামনে কোলসওয়ার্দি গ্রান্টের স্মৃতিস্তম্ভ, চিত্র সৌজন্য: Wikimedia Commons; (ডানদিকে) বিই কলেজ, অধুনা আই.আই.এস.ই.আর-এর প্রেক্ষাগৃহে স্মৃতিফলক, চিত্র সৌজন্য: লেখক

যদিও গ্রান্টের জীবন ছিল কর্মবহুল, তবু ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর সময়ে অবশ্যই তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল পশুপীড়ন নিবারণী সভার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। গ্রান্ট ও সংস্থার অন্যান্য সদস্যদের বহু প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ তৎকালীন সরকার দু’টি আইন প্রণয়ন করেন জন্তু-জানোয়ারদের প্রতি অহেতুক হিংসার প্রতিরোধ করতে। এই আইনের ফলে অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই আইনগুলি আজও বলবৎ, তবে বর্তমানের কথা ভেবে সময় হয়েছে এই আইনগুলির আধুনিকীকরণ করানোর। গ্রান্টের আর একটি অবদান হল শহরের প্রথম পশু-হাসপাতাল। বউবাজার অধুনা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিটে অবস্থিত, কোলসওয়ার্দি গ্রান্টের অপর এই স্মারকটি আজও সমান কর্মচঞ্চল।

পশুপীড়ন নিবারণী সংস্থার পশু হাসপাতাল,  চিত্র সৌজন্য: লেখক

ঋণ: trove.nla.gov.au; amazon.co.uk