এইবার তোমাদের কাছে যাঁর কাহিনি বলব তিনি ভারতবর্ষের একজন মস্ত বড় কবি— মহাকবি কালিদাস৷ পণ্ডিতেরা বলেন কালিদাসের সময়ে ভারতবর্ষে রাজত্ব করতেন গুপ্তবংশের রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত৷ তাঁর উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য, তাই বিক্রমাদিত্য নামেই তিনি বিখ্যাত৷ তাঁর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনীতে৷ এখনকার পশ্চিম ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যে উজ্জয়িনী অবস্থিত৷ রাজা বিক্রমাদিত্য পণ্ডিত লোকদের খুব সম্মান করতেন৷ সমস্ত ভারতবর্ষ খুঁজে খুঁজে ন’জন সেরা পণ্ডিত তাঁর সভায় তিনি এনেছিলেন৷ তাঁদের বলা হত ‘নবরত্ন’৷ কালিদাস ছিলেন এই নবরত্নের একজন৷
কালিদাস সম্বন্ধে একটা ভারী চমৎকার গল্প আছে৷ গল্পটা নিশ্চয়ই তোমাদের ভাল লাগবে, তাই বলছি৷
এক রাজার একটি মেয়ে ছিল৷ মেয়েটি খুব সুন্দরী৷ কিন্তু কিছুতে তাঁর বিয়ে হচ্ছিল না, কারণ উপযুক্ত বর পাওয়া যাচ্ছিল না৷ রাজকুমারী খুব লেখাপড়া করেছিলেন, তাই তিনি পণ করেছিলেন যিনি তাঁকে তর্কে হারাতে পারবেন তাঁকেই তিনি বিয়ে করবেন৷ কত জায়গা থেকে কত রাজকুমার এলেন, কত পণ্ডিত এলেন, কিন্তু রাজকুমারীকে তর্কে হারাতে পারলেন না কেউ৷ শেষে কয়েকজন পণ্ডিত মিলে ঠিক করলেন রাজকুমারীকে জব্দ করতে হবে৷ তাঁর সঙ্গে একজন মূর্খ লোকের বিয়ে দিতে হবে৷ তাঁরা বেরলেন সেই মূর্খের সন্ধানে৷
পথে যেতে যেতে দেখলেন একটি যুবক একটি গাছের ডাল কাটছে৷ কিন্তু সে এমনই বোকা যে, নিজে যে ডালে বসে আছে সেই ডালই কাটছে। ডাল কাটা হয়ে গেলে সে নিজেও যে ডালের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যাবে, সে বুদ্ধি তার নেই৷ তাঁরা দেখলেন এই যুবকই রাজকুমারীর যোগ্য বর হবে৷ তাঁরা যুবকটিকে নিচে নেমে আসতে বললেন৷ সে নিচে নেমে এল৷ পণ্ডিতেরা দেখল যে ছেলেটি সুদর্শন। তার বড় বড় চোখ, মায়াভরা মুখ।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে সে এক রাজকুমারীকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না৷ রাজার জামাই হতে কে না চায়! সে রাজি হয়ে গেল৷ তাকে শিখিয়ে দেওয়া হল রাজকুমারীকে বিয়ে করতে হলে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মুখে কোনও কথা বলা চলবে না৷ রাজকুমারী কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ইশারায়, আঙুল নেড়ে তার উত্তর দিতে হবে৷
তারপর পণ্ডিতেরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাজার কাছে গেলেন৷ বললেন— ‘মহারাজ, আমাদের সঙ্গে এই যে যুবক এসেছেন, ইনি মহাপণ্ডিত, রাজকুমারীর সঙ্গে ইনি তর্ক করবেন, তবে এক ব্রতের জন্য এখন উনি কোনও কথা বলতে পারবেন না, ইশারায় রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর দেবেন৷’
সভাতে রাজকুমারী এসে বসলেন, আর তাঁর সামনে বসলেন মূর্খ যুবকটি৷ তার সুন্দর চেহারা দেখে রাজকুমারীর প্রথমেই ভাল লেগে গেল৷ তারপর তিনি প্রশ্ন আরম্ভ করলেন আর যুবকটি কখনও একটা আঙুল কখনও-বা দুটো, কখনও-বা তিনটে আঙুল দেখিয়ে রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল৷ পণ্ডিতরা বলতে লাগলেন তার উত্তর ঠিক হয়েছে৷ আশ্চর্য কথা, রাজকুমারী এবার হার স্বীকার করলেন ও সেই যুবককে বিয়ে করতে রাজি হলেন৷
খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল রাজকুমারীর আর সেই যুবকের৷ রাজকুমারী খুব খুশি কারণ তাঁর এক সুন্দর চেহারার মহাপণ্ডিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে; আর পণ্ডিতেরা খুশি তাঁর সঙ্গে এক মহামূর্খের বিয়ে দিতে পারলেন বলে; আর মুর্খ যুবক খুশি রাজার মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছে বলে৷
রাত্রে বর-বউ শুতে এসেছেন ঘরে, এমন সময়ে বাইরে একটি উটের ডাক শোনা গেল৷ বর এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি, তাই তাকে কথা বলাবার জন্য রাজকুমারী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘বলুন তো বাইরে কী ডাকল?’
যুবক দেখল বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন এবার কথা বলা যেতে পারে৷ কারণ তাকে বলা হয়েছিল বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কথা না বলতে৷ সুতরাং সে রাজকুমারীর কথার উত্তর দিয়ে বললে— ‘উট্র’৷ রাজকুমারী এত লেখাপড়া জানেন! তাঁর সঙ্গে তো আর সাদাসিধে ভাষায় কথা বলা যায় না! সাধুভাষা বলাই উচিত৷ রাজকুমারী স্বামীর কথা শুনলেন, কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না৷ ভাবলেন তাঁর স্বামী নিশ্চয়ই ‘উষ্ট্র’ বলেছেন, তিনি ভুল শুনেছেন৷ তবু আর একবার ভাল করে শোনবার জন্য তিনি বললেন— ‘কী বললেন? আপনার কথা বুঝতে পারলুম না৷’
যুবক মনে মনে ভয় পেল— ‘তবে কি ভুল বলেছি, উট্র হবে না, উষ্ট হবে?’ ভুল শুধরে নেওয়ার জন্য সে এবার বলল— ‘উষ্ট’৷
রাজকুমারী বেশ বুঝতে পারলেন কৌশল করে তাঁকে এক মহামূর্খের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ লজ্জায়, ঘৃণায় তাঁর ইচ্ছা হল মাটিতে মিশে যেতে৷ কিন্তু কী করেন, মন্ত্র পড়ে বিয়ে হয়েছে দু’জনের, বিয়ে তো মানতেই হবে৷ তবু রাগের মাথায় তিনি মূর্খ স্বামীকে ঘর থেকে বার করে দিলেন৷
রাজকুমারীর এই অপমান খুব মনে লাগল যুবকের৷ ‘মূর্খ বলে বউ তাড়িয়ে দেবে? বেশ, লেখাপড়া শিখে পণ্ডিত হয়ে তবে আসব’, যুবক মনে মনে ঠিক করল৷ তারপর শুরু হল তার লেখাপড়া শেখার সাধনা৷ দিনের পর দিন মন দিয়ে পড়াশোনা করে অতি অল্প দিনের মধ্যেই যুবক হয়ে উঠল মহাপণ্ডিত, একেবারে সরস্বতীর বরপুত্র৷ অনেকে বলেন, যুবক রাজকুমারীর কাছে অপমানিত হয়ে নদীতে ডুবতে যাচ্ছিল; এমন সময় সরস্বতী তাকে বর দেন যে সে মহাপণ্ডিত হবে৷
তোমাদের বোধহয় বলে দিতে হবে না যে এই যুবকই হলেন কালিদাস৷ কালিদাস যখন পণ্ডিত হয়ে রাজকুমারীর কাছে ফিরলেন তখন রাজকুমারীর আনন্দ আর ধরে না৷ তাঁকে আদর করে ঘরে নিয়ে গেলেন, আর একদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে ক্ষমা চাইলেন৷
কালিদাস নাটক আর কাব্য লিখে গেছেন সেই দেড় হাজার বছর আগে৷ কিন্তু আজও তাঁর আদর কমেনি৷ সমস্ত পৃথিবীতে কালিদাসের নাম ছড়িয়ে পড়েছে মহাকবি বলে৷ কালিদাসের লেখা নাটকের মধ্যে সব চেয়ে ভাল হচ্ছে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’— এতে রাজা দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার গল্প আছে৷ আর কাব্যের মধ্যে সব চেয়ে বিখ্যাত হল— ‘মেঘদূত’ ও ‘কুমারসম্ভব’৷
ঋণ: ইতিকাহিনি, সমরেন্দ্রকৃষ্ণ সরকার