এক রাজা৷ তাঁর চার ছেলে৷ বড় দুই ছেলের টুকটুকে বউ এসেছে ঘরে, এবার তৃতীয় রাজকুমারের জন্য রাজা চারদিকে পাত্রী দেখছেন৷ তৃতীয় রাজকুমার রোজই প্রভাতে ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য পরিদর্শন করে আসেন৷ একদিন যখন রাজকুমার ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছেন তখন শুনতে পেলেন রাজবাড়ির দর্জির বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন মিষ্টি সুরে দর্জিকে ডাকছে, ‘বাবা, খাবার খেয়ে যাও৷’
রাজপুত্র এদিক সেদিক চাইলেন, কিন্তু দর্জিকন্যাকে দেখতে পেলেন না৷ রাজপুত্র দিনের পর দিন দর্জির বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যান আর শোনেন অতি মিষ্টি সুরে কে যেন দর্জিকে ডেকে-ডেকে কথা বলছে৷
রাজপুত্র একদিন বাড়ি ফিরে গিয়ে শয্যা নিলেন। সেদিন স্নান করলেন না, খেলেন না৷ রাজবাড়ির অন্দরমহলে সে খবর গেল৷ রাজা-রানি ছুটে এলেন―কী হল, কী হল, রাজপুত্র কেন খায় না, কেন স্নান করে না? রাজা-রানি অনেক সাধ্য-সাধনা করলে কুমার বললেন, ‘বাবা, আমি দর্জিকন্যাকে বিয়ে করব৷’ রাজা বললেন, ‘এ আর কী কঠিন বিষয়! এরই জন্য তুমি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছ?’
তখুনি দর্জির কাছে খবর গেল, রাজা তাকে ডাকছেন৷ অসময়ে কেন দর্জির ডাক পড়ল সে ভেবে পায় না৷ যাহোক, সে তাড়াতাড়ি রাজবাড়িতে এসে হাতজোড় করে বললে, ‘রাজামশাই, আমাকে কেন ডেকেছেন?’
রাজা বললেন, ‘বিয়ের বন্দোবস্ত করো, কাল তোমার মেয়ের সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে৷’
দর্জি তো আকাশ থেকে পড়ল৷ বলল, ‘রাজামশাই, আমার তো মেয়েই নেই, আমি কী করে রাজপুত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব?’
রাজা কিছুতেই বিশ্বাস করেন না৷ বলেন, “তোমার বাড়িতে মেয়ে না থাকলে কে তোমাকে রোজ ‘বাবা, খেতে এস’ বলে ডাকে? কার গলার সুর এত মিষ্টি?”
দর্জি হাতজোড় করে বললে, ‘রাজামশাই, আমার দোষ নেবেন না, ও তো আমার পোষা ময়না৷’ রাজপুত্র বললেন, ‘আমি ওকেই বিয়ে করব৷’
পরদিন খুব ধুমধাম করে রাজপুত্রের সঙ্গে ময়নার বিয়ে হয়ে গেল৷ রাজা আলাদা এক সুন্দর মহল সাজিয়ে দিলেন ছেলে ও বউয়ের জন্য৷ এ বিয়ে কেউ দেখতে পেল না৷ রাজা রটিয়ে দিলেন কুমারের বউ অপূর্ব সুন্দরী, তাই বধূ অন্দরমহলে বন্দি থাকবে, কেউ দেখতে পারবে না৷
রাজপুত্রের দিন ভালই কাটে৷ ময়না তার মিষ্টি সুরে কত দেশ-বিদেশের কথা বলে, কত গান শোনায়৷ আর রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য ঘুরে-ঘুরে যত সুপক্ক মিষ্টি ফল আছে ময়নার জন্য পেড়ে আনেন, ময়নাকে খাওয়ান৷ ময়না সোনার খাঁচায় থাকে, মখমলের নরম গদিতে শোয়, সোনার বাটি থেকে ঠোঁট ভিজিয়ে জল খায়৷
কিছুদিন পর সবার ছোট রাজপুত্রের বিয়ে, রাজ্যে হইচই লেগে গেছে৷ বড় দুই বউ তৃতীয় রাজপুত্রকে বললে, ‘কুমার, তোমার সুন্দরী বউকে তো বন্দিনী করে রেখেছ, আমাদের দেখতেও দাও না৷ এবার ছোট কুমারের বিয়ে, তোমার বউ এসে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে৷ আমরা একা সবদিক সামলাতে পারব না৷’
রাজপুত্র আপন ঘরে ফিরে বিষণ্ণ মুখে শুয়ে রইলেন৷ তা দেখে ময়না ডাকতে লাগল, ‘কুমার, ও কুমার, তোমার হল কী, কথা বলছ না কেন?’ কুমার খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ময়না, তুমি তো পাখি, তুমি আমার অবস্থা কী আর বুঝবে! ছোট রাজকুমারের বিয়ে, দুই বউদি ধরে বসেছেন তোমাকে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কাজ করতেই হবে৷’
ময়না বললে, ‘এর জন্যে ভাবনা? আমি ভাবছি, না জানি কী বিষয়! ওঠো, মুখ ধোও, খাও আর বউদের গিয়ে বল— আমার বউ কারও সামনে বের হয় না৷ তোমাদের যা কাজ আছে একটা মহলে তা রেখে তোমরা সব চলে যাও৷ সকালে উঠে দেখতে পাবে রাত্তিরে বউ সব কাজ করে গিয়েছে৷’
রাজপুত্র গিয়ে ময়নার কথামতো ভায়ের বউদের সব বললেন৷ তারা বললে, ‘তোমার বউ এমনই গুণবতী, এক রাত্তিরে সব কাজ করবে? আচ্ছা দেখা যাক কী হয়৷’ এই বলে রাজবাড়ির এক মহলে একটা ঘর বোঝাই করে ধান রেখে বললে, ‘তোমার বউকে এ ধান থেকে চাল বের করতে হবে৷ কিন্তু খবরদার একটা চালও ভাঙা থাকবে না৷’
রাজপুত্র মনে মনে ভেবেই পান না, একটা ছোট ময়না পাখি কী করে এই ঘরভরতি ধানের চাল রাতারাতি বার করবে! কাল বাড়ির সবাইয়ের কাছে অপদস্থ হতে হবে ভেবে রাজপুত্রের মুখ কালো হয়ে উঠল৷ বাড়ি গিয়ে রাজপুত্র চুপ করে শুয়ে রইলেন৷
ময়না তার অতি মিষ্টি সুরে ডেকে উঠলে, ‘কুমার, কীসের জন্য এত ভাবনা?’ রাজপুত্র বউদিদের সব কথা খুলে বললেন৷ তখন ময়না বললে, ‘কিছু ভাবনা নেই, তুমি রাত গভীর হলে আমার খাঁচার দরজা খুলে দিও, আমি সব কাজ শেষ করে ভোরে ফিরে আসব৷’ রাজপুত্র বললেন, ‘সে হয় না৷ আমি খাঁচার দরজা খুলে দিলে তুমি উড়ে নীল আকাশে চলে যাবে, আর ফিরে আসবে না৷’ ময়না উত্তর দিলে, ‘কুমার, আমাকে বিশ্বাস কর, আমি কোথাও তোমাকে ফেলে চলে যাব না৷’
রাজপুত্র ময়নার কথা বিশ্বাস ক’রে রাত হলে ময়নাকে ছেড়ে দিলেন৷ ময়না পাখা দুলিয়ে উড়ে চলে গেল জঙ্গলে৷ মিষ্টি সুরে ডেকে উঠল অন্য ময়নাদের৷ এই ময়না পাখি ছিল ময়নাদের রাজকুমারী৷ তাকে সবাই ভালবাসত৷ কাজেই তার ডাক শুনে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়না এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল৷ রাজকুমারী ময়না তাদের নিয়ে রাজবাড়িতে চলে গেল, তারপর সবাই ঠোঁট দিয়ে ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বের করে রাখল৷ আর ভোর হওয়ার আগেই আবার দল বেঁধে তাদের রাজকুমারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল৷
ময়না বউ ফিরে এল নিজের সোনার খাঁচায়৷ পরদিন ভোরে উঠে ঘরের দরজা খুলে বড় বউ দুটি তো থ’৷ ঘরে পাহাড়ের মতো স্তূপাকৃতি করে চাল সাজিয়ে রেখেছে সেজ বউ, আর অন্য দিকে সব তুষ জমা হয়ে আছে৷ সরু সরু সাদা চালগুলো ঝকঝক করছে রূপোর মতো৷ রাজ্যের লোকে সেজ বউয়ের কাজের খুব প্রশংসা করতে লাগল৷ আর রাজপুত্রের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বড় বউ দুটি মুখ কালো করে বললে, ‘ধান কুটে চাল বের করেছে তো ভালই হয়েছে৷ কিন্তু সেজ বউকে তো আজ আনতে হবে৷ এত বড় অন্দরমহলে রং দিতে হবে আমাদের সঙ্গে৷’
রাজপুত্র ভেবে পান না, ছোট্ট ময়না পাখির তো হাত নেই সে কী করে দেওয়ালে রং দেবে৷ বাড়ি ফিরে রাজপুত্র বিরস মুখে শুয়ে রইলেন৷ ময়না মিষ্টি সুরে ডেকে উঠল, ‘কুমার, আজ আবার কী হল তোমার?’ রাজপুত্র বললেন, ‘অন্দরমহলে রং দিতে হবে৷’ ময়না বললে, ‘কিছু ভেবো না কুমার, তোমার বউদিদের বলে এস গামলা ভরে রং গুলে তৈরি করে রেখে দিতে৷ আমি রাত্তিরে গিয়ে রং দিয়ে আসব৷’ রাজপুত্র বললেন, ‘তুমি একটা ছোট পাখি, তুমি কী করে রং দেবে?’ ময়না বললে, ‘তুমি শুধু রাত্তিরে আমাকে ছেড়ে দিও৷’ রাত্রে আবার ময়না উড়ে গেল জঙ্গলে৷ সব ময়না পাখিদের ডেকে নিয়ে এল রাজবাড়িতে৷ শত-শত পাখি মিলে রংয়ের গামলায় ডানা ঝাপটা মেরে ভিজিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ালে রং দিতে লাগল। ভোর হওয়ার আগেই সমস্ত মহলে রং দেওয়া শেষ হল৷ সব ময়না উড়ে চলে গেল জঙ্গলে, ময়না বউ বাড়ি ফিরে এল৷
পরদিন সবাই রাজবাড়ির রং দেখে খুব খুশি হয়ে সেজ বউয়ের প্রশংসা করতে লাগল৷ কিন্তু বড় বউ দুটির মন তাতে একটুও খুশি হল না৷ এরপর রাজা সেজকুমারকে ডেকে বললেন, ‘ছোট রাজপুত্র যাবে বিয়ে করতে, সঙ্গে যাবে বরযাত্রী৷ আমি চাই তুমিও যাও সেই বরযাত্রীদের সঙ্গে।’ সেজ রাজপুত্র পড়লেন মহাভাবনায়৷ তাঁকেও এই সঙ্গে ছয়-সাতদিনের জন্য অন্য রাজ্যে যেতে হবে৷ তিনি চলে গেলে তাঁর ময়নার কী উপায় হবে৷ কে দেবে দানাপানি? আবার রাজপুত্র এসে শয্যা নিলেন৷ ময়না মিষ্টি গলায় ডেকে উঠল, ‘কুমার, রাজকুমার, কী হল তোমার?’ কুমার বললেন, ‘ময়না, যদিও তুমি পাখি তবু তুমি আমার স্ত্রী৷ আমি যদি তোমাকে ছেড়ে ছয়-সাতদিনের জন্য ছোটকুমারের বরযাত্রীর সঙ্গে অন্য রাজ্যে যাই তবে তোমার কী হবে? কে তোমায় তাজা ফল এনে দেবে? কে তোমায় জল দেবে?’ ময়না মিষ্টি গলায় বললে, ‘কুমার, আমার জন্য ভেবো না৷ সাতদিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে৷ সাতদিনের মতো জল আর ফল আমার জন্য রেখে যাও৷’
রাজপুত্র আর কী করেন! ময়নার কথামতো সাতদিনের জন্য সোনার কৌটো ভ’রে প্রচুর জল রাখলেন৷ আর যত রকম পাকা-পাকা ফল হতে পারে তা সব সংগ্রহ করে রেখে গেলেন৷ ময়নাকে বললেন সাবধানে থাকতে৷ ময়না একা-একা মহলে ফল ঠুকরে ঠুকরে খায়৷ সোনার বাটিতে ঠোঁট ভিজিয়ে জল খায়, দিন গণনা করে আর মনের আনন্দে গান গায়৷
একদিন ময়না ভাবলে বাটির জলে একটু শরীরটা ভিজিয়ে নিই৷ এই ভেবে সে পাখা মেলে যেই বাটিতে ভিজতে গেছে অমনি বাটি উলটে সব জল নিচে গড়িয়ে পড়ল৷ ভয়ে ময়নার বুক শুকিয়ে উঠল৷ এখনও আরও তিনদিন বাকি কুমার আসবার৷ এই তিনদিন জল ছাড়া তো সে ছটফট করে মরে যাবে৷ ময়না অস্থির হয়ে উঠল৷ সারাদিন সমস্ত শরীর দিয়ে মাথা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে খাঁচার শিক একটু ফাঁক করে বহুকষ্টে ময়না বের হল, তারপর সে উড়ে চলল নদীতে তার নিজের জন্য পাতার ঠোঙায় করে জল আনবে৷
নদীতে নেমে ময়না বেশ করে স্নান করে নিল৷ তারপর একটা পাতার ঠোঙা ভ’রে জল নিল, কিন্তু জলভরা ঠোঙা ঠোঁটে ধরে সে কিছুতেই উঠতে পারে না৷ সে নদীর জল থেকে ওপরে ওঠে, ঠোঙার জল নিচে পড়ে যায়৷ এভাবে সে জলভরা ঠোঙা নিয়ে নদীতে হাবুডুবু খেতে লাগল৷
এমন সময় আকাশপথে শিব-পার্বতী যাচ্ছিলেন৷ পার্বতী দেখতে পেলেন একটি ছোট ময়নাপাখি জলভরা ঠোঙা নিয়ে নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে, উঠতে পারছে না৷ দেখে পার্বতীর বড় দয়া হল, তিনি শিবকে বললেন, ‘প্রভু, এই পাখিটার বড় কষ্ট হচ্ছে, তুমি তাকে এক রাজকুমারী বানিয়ে দাও৷ তাহলে সে সুখে রাজপুত্রের ঘর করবে৷’ শিব বললেন, ‘পার্বতী, তোমার দয়ার শরীর৷ তুমি তো কারও দুঃখ-কষ্ট দেখতে পার না, কিন্তু তোমার জন্য তো আমার সৃষ্টির অদল-বদল হয়ে যাচ্ছে৷ এই ময়নাপাখিকে কেন রাজকুমারী করব? চল এখন স্বর্গে ফিরে যাই৷’ কিন্তু পার্বতী নাছোড়বান্দা, কাজেই শিবের বরে ময়নাপাখি অপূর্ব রূপসী এক রাজকন্যা হয়ে গেল৷ সর্বাঙ্গে হীরে মোতির গয়না, পায়ে সোনার নূপুরের ঝমর-ঝমর আওয়াজ করে কন্যা মহলে ফিরে গেল৷
এদিকে সাতদিন পর সেজ রাজপুত্র ছোটভাই ও তার বউসহ নিজরাজ্যে ফিরে এলেন৷ তিনি তাড়াতাড়ি নিজ মহলে ছুটে এলেন তাঁর সাধের ময়নাকে দেখতে৷ কিন্তু এসে দেখেন, হায় হায় তার ময়না বউয়ের সোনার খাঁচার শিক ফাঁক হয়ে আছে, সোনার বাটি উলটে পড়ে আছে, ময়না নেই৷ রাজপুত্র ‘ময়না-ময়না’ বলে পাগলের মতো ঘরে ঘরে ঘুরতে লাগলেন৷ তারপর তাঁর নিজের শয়নকক্ষে গিয়ে দেখতে পেলেন এক পরমা রূপসী কন্যা রূপে ঘর আলো করে পালঙ্কে বসে আছে৷ রাজপুত্র দেখে তো আশ্চর্য হয়ে গেলেন৷ হাতজোড় করে বললেন, ‘দেবি, তুমি কে? দয়া করে বল আমার ময়না কোথায়?’
রূপসী কন্যা পালঙ্ক থেকে নেমে রাজপুত্রকে প্রণাম করে বললে, ‘কুমার, আমিই তোমার ময়না৷’ এই বলে কন্যা তার সব কাহিনি খুলে বলল৷
রাজপুত্রের আনন্দের অন্ত রইল না! দু’জনে মিলে শিব-পার্বতীর উদ্দেশে ভক্তিভরে প্রণাম জানালেন৷ রাজপুত্র তাঁর সুন্দরী বউকে নিয়ে রাজমহলে হাজির হলেন৷ সেজবউ যে অপূর্ব রূপসী সেকথা রাজ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল৷
বুড়ো রাজা সেজছেলের পাগলামীতে মনের দুঃখে ছিলেন৷ এবার তাঁর খুশির অন্ত রইল না৷ চার ছেলের চার রূপসী বউ নিয়ে তিনি মহানন্দে রাজ্য করতে লাগলেন৷
ঋণ: শিশুসাথী ১৯৫৮